ট্রফি জয়ের স্বপ্ন নিয়ে টুর্নামেন্টের চূড়ান্ত খেলায় ব্যাটিং করতে গিয়ে খেলার মাঠেই লুটিয়ে পড়েন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান সিয়াম। শেষ মুহূর্তে তার মুখে একটিই কথা ছিল, “পানি খাব।”
সম্প্রতি বিভাগটির শিক্ষার্থীদের নিয়ে শুরু হয় আন্তঃবর্ষ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। গত কয়েকদিন ধরে চলা এ টুর্নামেন্টে বাহারি নামে দল গঠন করে উৎসবমুখর পরিবেশে খেলছিলেন শিক্ষার্থীরা। আয়োজক কমিটিতে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন মেহেদী হাসান সিয়াম। বিভাগের ‘খেলা পাগল’ নামেই তিনি পরিচিত। এজন্য সবার সম্মতিতে তাকেই এ দায়িত্ব দেওয়া হয়।
রবিবার (১ ডিসেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাশ বাংলাদেশ মাঠে এ খেলায় চূড়ান্ত পর্বে মুখোমুখি হয় ম্যানডামাস একাদশ ও হেবিয়াস কর্পাস একাদশ। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায় পারদর্শী সিয়াম ছিলেন ম্যানডামাস একাদশের দলীয় অধিনায়ক।
একদিকে ভালো খেলার তাড়না, অন্যদিকে নেতৃত্বের চাপ। কিন্তু খেলা পাগল সিয়াম ছিলেন নির্ভার, খেলছিলেন নিজের মতো করেই চিরাচরিত স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে। চেহারায় নেই ক্লান্তি বা চিন্তার ছাপ, মুখে লেগে থাকা সেই এক চিলতে হাসি।
খেলছিলেন নন-স্ট্রাইকে, অপর প্রান্তে স্ট্রাইকে ছিলেন একই বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শাহ আলম সাজু। নিজে খেলার পাশাপাশি জুনিয়রকে নানা দিকনির্দেশনাসহ নির্ভয়ে ব্যাটিং করে যাওয়ার উৎসাহও দিচ্ছিলেন। বিকেল ৪টার দিকে হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে, ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে পুরো প্রাণোচ্ছ্বল মাঠ।
পানি চেয়েই ২২ গজের পিচেই লুটিয়ে পড়েন ম্যানডামাস কাপ্তান সিয়াম। মাঠে থাকা অন্যরা দ্রুত ছুটে আসেন। তবে তারা মুখে কোনো কথা ছিল না। মাঠে থাকা বিভাগের শিক্ষকরাও ছুটে আসেন। সেখান থেকে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু তার হৃদস্পন্দন না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে দ্রুত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) স্থানান্তরের নির্দেশনা দেন। পরে রামেকে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তার মৃত্যু ঘোষণা করেন। বিজয়ের স্বপ্ন নিয়ে মাঠে যাওয়া এ খেলা পাগল হেরে যান; খেলায় নয়, জীবনের লড়াইয়ে।
তার মৃত্যুর কারণে এ টুর্নামেন্ট প্রত্যাহার করা হয়। এতে কোনো দলই চ্যাম্পিয়ন বা রানার্স আপ হয়নি। তবে শিক্ষার্থীদের চাওয়া অনুযায়ি বিভাগ সিয়ামকে এককভাবে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে। তিনি আন্তঃবর্ষ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অপ্রতিদ্বন্দ্বী চ্যাম্পিয়ন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে শিবগঞ্জ উপজেলার রাণীনগর গ্রামের আব্দুস সাত্তারের তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে ম্যানডামাস অধিনায়ক ছিলেন দ্বিতীয়। এ অকাল মৃত্যুতে তার পরিবার ও বিভাগে নেমেছে শোকের ছায়া। ‘খেলা পাগল’ ছেলেটাকে আর দেখা যাবে না বলে আহাজারি করছিলেন সহপাঠীরা।
খেলার সময় তার সঙ্গে মাঠে থাকা সতীর্থ শাহ আলম সাজু বলেন, “গত দিনগুলোর মতোই তিনি খুবই স্বাভাবিক ছিলেন। ১০ম ওভারে আমি স্ট্রাইক প্রান্তে আউট হয়ে মাঠ ছাড়ার সময় ভাই পানি চান। পানি নিয়ে যাওয়ার আগেই মাঠে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এখন পর্যন্ত তিনিই সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন।”
অশ্রুস্বজল চোখে তিনি বলেন, “সিনিয়র হিসেবে তিনি ছিলেন অমায়িক একজন মানুষ। কথা বলার সময় তার মুখের হাসি যেকোনো মানুষের মন ভালো করে দিতে পারত। আমার ক্যাপ্টেন, আমার ভাই এভাবে ছেড়ে চলে যাবেন- কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। আল্লাহ্ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক।”
একই বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, “সিয়াম ভাইয়ের চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছি না। ভাইয়ের সাঙ্গে আমার মাঝে মাঝে অনেক খুঁনসুটি হতো। ভাইয়ের হলের সিট আমি বারবার চাইতাম। ভাই মাঝে মাঝে মজা করে বলতেন, ‘তুই অনেক ভণ্ড, তোকে দেব না।’ তিনি অনেক হাসিখুশি, অমায়িক একজন মানুষ ছিলেন। প্রথম ম্যাচে হারার পর আমাকে হেসে বললেন, ‘তুই কুফা।’ ফাইনালে উঠে আবার আমাকে হেসে বললেন, ‘তুই ভালো, কুফা না।’”
তিনি বলেন, “শেষ সময়ে টিমের সদস্য হয়ে গতকালও কথা হয়েছিল ভাইয়ের সঙ্গে। টিম চাম্পিয়ন হলে পিকনিকে আমাকে রাখবেন বলেছিলেন। আর আজ উনিই থাকলেন না, রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন।”
রবিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে তার প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হলে রাতেই রাণীনগরে নিয়ে যাওয়া হয়। সোমবার (২ ডিসেম্বর) বেলা ১১টায় দ্বিতীয় নামাজে জানাযা শেষে নিজ গ্রামে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়।
সিয়ামের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকরা মৃত্যুর কারণ হিসেবে কার্ডিয়াক অ্যাটাকের (হৃদরোগে আক্রান্ত) কথা জানিয়েছেন। লড়াই করে ট্রফি জিতে ছুঁয়ে দেখার স্বপ্নটা অপূর্ণই রয়ে গেল। তবে এটা তারই ট্রফি, এমনটাই দাবি বিভাগের সব শিক্ষার্থীর। এজন্য বিভাগের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীরা সিয়ামের সম্মানে তার বাড়িতে দিতে যান ট্রফিটা।
কিন্তু তার কিছু জিনিস বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকায় ট্রফিটা আবার ফিরিয়ে আনা হয়। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তার সব জিনিসসহ ট্রফিটা বাড়িতে দিয়ে আসা হবে। হাতে না নিলেও ট্রফিটা পরিবারের কাছে সিয়ামের স্মৃতি হিসেবে থাকবে।
আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আশিক রহমান বলেন, “সিয়াম ভাই ছিলেন একজন খেলা পাগল মানুষ। বিভাগের সব খেলার আয়োজনে তিনি সবসময়ই এগিয়ে থাকতেন। সিয়াম ভাইয়ের সম্মানে বিভাগের সভাপতির কাছে আমরা ট্রফিটি তার বাড়িতে দিয়ে আসার আবেদন করি, বিভাগ রাজি হয়েছে। ভাইয়ের প্রতি এটা আমাদের একটি সম্মান প্রদানের বড় সুযোগ বলে মনে হয়েছে। সম্পূর্ণ টুর্নামেন্টটি ভাইয়ের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে।”
অশ্রুস্বজল চোখে আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগের সভাপতি ড. মো. সাহাল উদ্দিন বলেন, “সে আগে থেকেই খেলা পাগল ছিল। এজন্য তার সহপাঠীরা এবং বিভাগের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা মনে করেছে, খেলার ট্রফিটা তাকে দেওয়া উচিত।”
তিনি বলেন, “তার সম্মানে আমরা ট্রফিটা আজ নিয়ে গেছিলাম তার বাসায়; তবে দেওয়া হয়নি। আমরা ট্রফিটা ফেরত এনেছি। তার আরও কিছু জিনিস এখানে আছে। আমরা সেগুলোর সঙ্গে ট্রফিটা তার বাড়িতে দিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”