৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে জন্ম হয় স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শক্তি হিসেবে কাজ করেছিলেন তৎকালীন তরুণরা। আবার ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক জুলাই-আগষ্ট বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে এই তরুণ প্রজন্ম, যারা জেনারেশন জেড সংক্ষেপে জেন-জি হিসেবে পরিচিত। এজন্য দেশের প্রতি তরুণদের উদ্যোগী হওয়া খুব জরুরি। বিজয় দিবস নিয়ে নোয়াখালী সরকারি কলেজ শিক্ষার্থীদের ভাবনা রাইজিংবিডির পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো।
আগামী প্রজন্মকে দুর্নীতি মুক্ত দেশ উপহার দিতে পারলে স্বাধীনতা স্বার্থক বিজয় দিবসের কথা মনে পড়লে চোখের সামনে ভেসে উঠে এক স্বাধীন দেশের প্রতিচ্ছবি। যেখানে জনগণ স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে, কথা বলবে, দেশের নাগরিক হিসেবে সব অধিকার নিশ্চিত হবে। ১৯৭১ এর আগে মানুষ এসব অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধ করে দেশে স্বাধীন করেন। কিন্তু ৭১ এর পরবর্তী সময়ে দেশে ধীরে ধীরে ফ্যাসিবাদের রাজত্ব কায়েম হয়, ক্ষুণ্ন হয় সব ধরনের মৌলিক চাহিদা ও অধিকার; যা ২০২৪ সালে এসে চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।
নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ, হত্যা, ধর্ষণ, দুর্নীতি সবকিছু মিলিয়ে দেশ পুনরায় স্বৈরাচারের রোষানলে পড়ে। দেশের জনগণ ভেবেই নিয়েছিলেন, এ স্বৈরাচার থেকে সহজে মুক্তি নেই। কিন্তু দেশের ছাত্র-জনতা বরাবরের মতোই তাদের বিপ্লবী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ২০২৪ এর রক্তক্ষয়ী জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে তারা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হন। প্রায় ১ হাজার ৫০০ শহীদ ও কয়েক হাজার আহতের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশ গঠনে শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমে পড়ে।
দেশ গঠনের কাজে তারা দিনরাত এক করে কাজ করে যাচ্ছেন। এজন্যই বোধহয় ২৪ এর বিজয় দিবস অন্য কোনো বিজয় দিবস থেকে একটু আলাদা। এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা স্মরণীয় রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। আগামী প্রজন্মকে যদি দুর্নীতি মুক্ত একটি সুন্দর দেশ উপহার দিতে পারি, তবেই আমরা জনগণের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবো; স্বার্থক হবে আমাদের স্বাধীনতা। (লেখক: ইখতেয়ার হোসাইন আয়াত, শিক্ষার্থী, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ, রসায়ন বিভাগ)
বিজয় যেন বিফল না হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক গোষ্ঠী মেতে উঠে এক রক্তাক্ত খেলায়। অপারেশন সার্চলাইটের নামে চালায় গণহত্যার স্টিম রোলার। বাঙালিদের উপর এ অত্যাচারের শুরুটা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরপরই। প্রথমেই আঘাত হেনেছিল বাঙালির মায়ের ভাষা বাংলার উপর। ধীরে ধীরে তা রূপ নেই রাজনৈতিক বৈষম্যে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র নির্বাচনে, ৫৮’র সামরিক শাসন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান আর ৭০’র নির্বাচন তারই স্বাক্ষী।
কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও বাঙালি কেনো আবার খুঁজে বেড়ায় তাদের স্বাধীনতা? ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করলেও প্রকৃত বিজয় অর্জন আজও সম্ভব হয়নি। তাই তো বাংলার ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আপামর জনতা আবারও প্রমাণ করে, বাঙালির ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। ২৪ এ এসে আবারও বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছে স্বৈরশাসক, খুনি, অত্যাচারী ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে। বাঙালি দেখিয়ে দিয়েছে, তারা দুর্বার। বাঙালী উদ্দাম, বাঙালী সদা জাগ্রত প্রহরী।
তবে কথায় আছে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। সুতরাং আমাদের এ বিজয় যাতে বিফল না হয়, সে ব্যাপারে সদা জাগ্রত থাকতে হবে। তবেই স্বৈরাশাসন বাঁধতে দ্বিধান্বিত হবে এ বাংলায়। (লেখক: আফসানা আক্তার, শিক্ষার্থী, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ, অর্থনীতি বিভাগ)
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিজয় দিবসকে স্মরণীয় রাখতে হবে প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় দিবস হিসেবে পালন করি। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা আমাদের বাঙালিদের কাছে মহামূল্যবান। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করে একটা স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি, কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা পাইনি। দুঃখজনক হলেও সত্য, পরবর্তীতে অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি, অনিয়মের বেড়াজাল, ক্ষমতার লোভ আমাদের বিজয়ের আনন্দ ও আমাদের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। ফলে আমাদের আরেকবার মুক্তির চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দেশ রক্ষায় লড়তে হয়েছে।
বিজয় দিবসকে স্মরণ করা হয় একটি বিশেষ দিনে। কিন্তু এ অর্জিত বিজয়ের ধারা বহমান রাখার জন্য আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সাংস্কৃতিক বা স্কুল কলেজ কর্তৃক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা বিজয় দিবসকে শুধু একটি দিনে নয়, সারা বছর স্মরণীয় করে রাখতে পারি। (লেখক: সানজিদা আক্তার, শিক্ষার্থী, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ)
দেশের সব ক্ষেত্রে বিজয়ের ধারা অব্যাহত থাক স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব যেকোনো জাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। তবে এটি আপনা-আপনিই অর্জিত হয় না। এটা অর্জনের জন্য স্বীকার করতে হয় সর্বোচ্চ ত্যাগ। এজন্য আমাদের সবারই উচিৎ, বিজয়ের চেতনা মনেপ্রাণে ধারণ করে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য অর্জনে কাজ করা। কিন্ত আফসোস, স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি; এ আমাদেরই ব্যর্থতা।
আমরা যদি বিজয়ের মর্মার্থ বুঝি এবং বিজয় দিবসের মাহাত্ম্যকে ধারণ করতে পারি- তাহলেই আমরা উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পারবো। আমার একটাই আশা, লাখো শহীদের রক্তে রক্তিম যে সূর্য উদিত হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে, সে সূর্যের আলো যাতে গ্রাস করতে না পারে পৃথিবীর কোনো অপশক্তি। এ বিজয়ের ধারা দেশের সব ক্ষেত্রে অব্যাহত থাকুক। " (লেখক: মো. জোনায়েত হোসেন, শিক্ষার্থী, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ, অর্থনীতি বিভাগ)
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ হোক গর্বিত মুক্তিযুদ্ধ আমাদের আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতার প্রতীক। ২০২৪ সালের বিজয়ের স্পিরিট এ চেতনার নবজাগরণ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে সাহস, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা নিয়ে আমাদের আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে।
বিজয়ের স্পিরিট মানে একতা, সমৃদ্ধি এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অঙ্গীকার। এ চেতনা প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও সৃজনশীলতার মিশেলে একটি উন্নত জাতি গঠনের প্রেরণা হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করে নতুন প্রজন্ম শুধু জাতীয় নয়, বৈশ্বিক পর্যায়েও দেশকে গর্বিত করতে পারবে। (লেখক: সামাদ হোসাইন, শিক্ষার্থী, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ)
অঙ্গীকার হোক দুর্নীতিমুক্ত ও নাগরিক অধিকারবান্ধব নতুন বাংলাদেশের বিজয় মানে উল্লাস বিজয় মানে নব চেতনা বিজয় মানে নতুন করে নতুন প্রজন্মের সূচনা! স্বাধীনতা আন্দোলনের এ বিজয় আমাদের শেখায়, পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে নতুন দিগন্তে স্বাধীনতার নিশান উড়িয়ে মুক্তভাবে বাঁচার। তাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এ বিজয় দিবসকে অমর করে রাখতে প্রয়োজন দুর্নীতি মুক্ত, দারিদ্র্যতা মুক্ত ও মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয় এমন বাংলাদেশ গঠনের।
দুঃখজনক হলেও সত্য ৭১’র বীর মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের একটি স্বাধীন দেশ এনে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার লোভ-লালসা ও বৈষম্যের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা পঙ্গুত্ব বরণ করে নিয়েছিল। জন্ম হয় স্বৈরাচারিতার। আমরা ক্রমান্বয়ে হারিয়েছিলাম বাক-স্বাধীনতা।
কিন্তু দাসত্ব আর পরাধীনতার শিকলে বাঙালিকে কেউ আবদ্ধ রাখতে পারেনি। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে তা আবার প্রমাণ করে দিল। অবিস্মরণীয় জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে পতন ঘটে স্বৈরাচার সরকারের। আমরা ফিরে পেয়েছিলাম আমাদের বাক-স্বাধীনতা। এ যেন ৭১’র অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে আরেকটি নতুন বিজয় অর্জন।
আমরা আশাবাদী, ১৬ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে নতুন বাংলাদেশের অঙ্গীকার হবে একটি দুর্নীতিমুক্ত, নাগরিক অধিকারবান্ধব, সমৃদ্ধিশীল, রাজনৈতিক অপশক্তি মুক্ত এবং মানুষের প্রকৃত রাজনৈতিক অধিকার সচেতন সম্পন্ন স্বপ্নের বাংলাদেশ। (লেখক: সুমাইয়া শিশির, শিক্ষার্থী, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ, রসায়ন বিভাগ)