জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার বিপ্লবে বিদায় নিয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকার। আবির্ভাব ঘটেছে নতুন বাংলাদেশের। বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ছাত্র রাজনীতি ও ছাত্র সংসদ প্রসঙ্গ। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের প্লাটফর্ম হিসেবে ছাত্র রাজনীতি ও ছাত্র সংসদ নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বাদ দিতে হবে
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করে। আর এমন নিয়ম করেছে যে, ক্যাম্পাসে থাকতে হলে ক্ষমতাশীল কোন না কোন দলের মধ্যে থাকতে হবে। হোক সেটা ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, তাবলীগ বা শিবির। অন্যদিকে, ছাত্রসংসদ একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যেখানে সাংসদরা জনমত বা গণতান্ত্রিক ভোটে সংসদে অংশ নিবেন। তারা হবেন শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি। সে ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ছাত্রদের চাহিদা সরাসরি প্রশাসনের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যমে আদায়ের একটা সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
তবে ছাত্র সংসদ হতে গেলে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের সমর্থন আদায় এবং স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে। নির্বাচিত হওয়ার আগে একজন প্রার্থীকে অবশ্যই তার কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। এসব কাজের মাধ্যমে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হবে এবং ব্যক্তি জীবনে রাজনীতিতে অংশ নিতে চাওয়া ছাত্রদের স্কিল ডেভেলপ হবে। তবে একটা বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, পাওয়ার ডায়নামিক হবে। গুটি কয়েকজনের হাতে ক্ষমতা আবদ্ধ রাখার সুযোগ নেই। নেতৃত্ব দিতে অক্ষম হলে তাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। (লেখক: সুমাইয়া ইসলাম সারা, শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ বিভাগ)
নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি চালু করতে হবে
অতীতে আমরা দেখেছি, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস অত্যন্ত ঘৃণিত এবং ভয়ংকর। এ রাজনীতি চর্চায় ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের মূল সংগঠনের উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে কাজ করে যায়। ফলে তারা তাদের নিজ সংগঠনের উদ্দেশ্য তথা ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কাজ করা থেকে দূরে সরে যায়। আমরা দেখেছি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগ, ছাত্রদল কিভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নের স্টিম রোলার চালিয়েছে। বুয়েটের আবরার ফাহাদের ঘটনা এখনো আমাদের গভীরভাবে কষ্ট দেয়। এছাড়াও ২৪ এর অভ্যুত্থানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের নির্মম নির্যাতনের দৃশ্য সবাই দেখেছি।
যখনই এসব লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠন ক্ষমতায় এসেছে তারা শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। অতীতের এ তীক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা চাই, একটি নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি ব্যবস্থা, যা হবে শিক্ষার্থীবান্ধব এবং তাদের উদ্দেশ্য হবে শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা।
এর একমাত্র সমাধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্দলীয় ছাত্র রাজনীতি, অর্থ্যাৎ ছাত্র সংসদ নির্বাচন। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এমন প্রতিনিধিদের নির্বাচন করবেন, যারা কোন নির্দিষ্ট দলের জন্য কাজ করবেন না। তারা শুধু শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে সচেষ্ট হবেন এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাবেন। (লেখক: মাহতাব চৌধুরী মাহি, শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ)
রাজনীতি হতে হবে শোষিত জনতার পক্ষে
আমার কাছে ছাত্র রাজনীতি হলো এক অনন্য শিল্প, যেখানে আমি থাকবো শোষিত জনতার পক্ষে। চাটুকারিতা নয়; ন্যায়কে ন্যায়, আর অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহসিকতাই রাজনীতির শিল্পশলা। সাধারণ ছাত্র সমাজের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম নিয়ে কাজ করা কিংবা তাদের ভবিষ্যতের জন্য ব্যতিক্রমী উদ্যোগ এবং তাদের সমস্যা সমাধানে বিশ্বস্ত ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের পাশাপাশি দেশের মানুষের পাশে থাকার এক অমৃত ছায়ায় হচ্ছে ছাত্র রাজনীতি।
রাজনীতি হোক শিল্পের মত, যেখানে কথা বলতে পারবে প্রতিটি জনতা। ছাত্র সংসদ নিয়ে কথা বলতে গেলেও একটা বিষয় সামনে আসে, তা হচ্ছে ক্যাম্পাসে বিদ্যমান ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে সব দল থেকে ছাত্র সংসদের প্রার্থী নির্বাচন করা। সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যাদের যোগ্য ও বিচক্ষণ মনে করবেন, তারাই নির্বাচিত হবেন। তবে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ রকম একটা নিয়ম থাকতে হবে, ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা সবসময় শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট দায়বদ্ধ থাকবে। তাদের যে কোন কর্মকাণ্ড হতে হবে জবাবদিহিতামূলক। (লেখক: মেহেদী হাসান সীমান্ত, শিক্ষার্থী, ইনস্টিটিউট অফ ইনফরমেশন সাইন্স)
প্রয়োজন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কার
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে আমরা পেয়েছি নতুন এক বাংলাদেশ। ক্যাম্পাসে বিদ্যমান ছাত্র সংগঠনগুলোকে কয়েকমাস তাদের দৃশ্যমান রাজনৈতিক কার্যক্রম ক্যাম্পাস বা তৎসংলগ্ন এলাকায় বন্ধ রাখা উচিত।
অন্যথায়, ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাস ও তৎসংলগ্ন এলাকাগুলোতে অস্থিরতা এবং সংঘর্ষ ঘটতে পারে। যেটা ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট করবে।
বাংলাদেশে প্রায় ৩৪ বছর যাবত ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না নিয়মিত। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে যেন মেধাবী তরুণ নেতৃত্ব উঠে আসে এ বিষয়ে প্রচেষ্টা করতে হবে। অনিয়মিত ও বিতর্কিত শিক্ষার্থীরা যেন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের নামে ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়ে নজর রাখা উচিত সবার। (লেখক: মো. ফাহাদ হোসেন, শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, অর্থনীতি বিভাগ)
শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন ছাত্র সংসদ
বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্র সংসদের প্রকৃতি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক কল্যাণে কাজ করা। কখনো কখনো ছাত্র রাজনীতি আবার জাতীয় সংকটেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। যেমনটি দেখা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উন্মেষের ক্ষেত্রে। তবে কালের আবর্তে ছাত্র রাজনীতি তার স্বকীয়তা হারিয়েছে এবং মূল রাজনৈতিক দলগুলোর আজ্ঞাবহ দাসে রূপান্তর হয়ে তাদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। ফলে শিক্ষার্থীদের কল্যাণ ও সুযোগের সমতা নিশ্চিতের বিষয়টি ফিকে হয়ে দেখা দিয়েছে।
এ অবস্থায় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় ও দাবি-দাওয়া পেশ করার কমন প্লাটফর্ম হিসেবে শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্বাচিত ছাত্র সংসদ একটি ইতিবাচক প্রতিষ্ঠান হতে পারে। তবে এ প্রতিষ্ঠান যেন কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গীভূত, লেজুড়বৃত্তিক বা এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয় যেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ছাত্র সংসদকে সময়োপযোগী করা গেলে একটু সুস্থ ধারার রাজনীতির বিকাশ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সম্ভব বলে আমি মনে করি। (লেখক: দিপু কুমার দেব, শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ)