ক্যাম্পাস

এক মঞ্চে শিবির-ইউনিয়ন-বৈষম্যবিরোধী

বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের অপরাজনীতি ছাত্র রাজনীতিকেই কলুষিত করেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্র রাজনীতি কি থাকবে? এ সংকট দূর করতে ছাত্র রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।

এরই অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ছাত্র ও রাজনীতি প্রশ্ন: নয়া স্বরূপ অভিসন্ধানের অভিপ্রায়’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যের পাদদেশে  ‘ডায়ালগ ফর ডেমোক্রেসি’র উদ্রোগে এ সভার আয়োজন করা হয়। এতে ছাত্র শিবির, ছাত্র ইউনিয়ন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।

ডায়ালগ ফর ডেমোক্রেসির আহ্বায়ক শেখ মো. আরমানের সভাপতিত্বে এতে বক্তব্য দেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সাধারণ সম্পাদক মেঘ মল্লার বসু, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাফিয়া রেহনুমা হৃদি প্রমুখ।

এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “জনগণের খয়রাতের পয়সায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে জ্ঞান বিস্তার করা, আপনার সুবিধাজনক চিন্তাগুলোকে পর্যাপ্ত ভাষা দিয়ে জ্ঞান ও গবেষণাভিত্তিক রাষ্ট্র তৈরি করা। কিন্তু বিদ্যমান যে দলীয় ছাত্র রাজনীতি রয়েছে, তা আপনাকে ক্লাস বাদ দিয়ে মধুর ক্যান্টিনে আসতে, রিডিং রুমে না গিয়ে নেতার পাশে হাততালি দিতে বাধ্য করেছে, আবাসিকতা থেকে বঞ্চিত করেছে।”

তিনি বলেন, “৫ আগস্টের পর ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ উৎখাতে পর কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট আবাসন সংকটের সমাধান হয়ে গেছে। তার মানে দলীয় ছাত্র রাজনীতি যে নামেই থাকুক না কেন, সেগুলো শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে তাদের মাদার পার্টির পারপাস সার্ভ (উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন) করে। আপনি যদি ৪৮ দেখেন, কিংবা ৭১, ৯০, ১৮, ২৪ দেখেন, তাহলে ছাত্র রাজনীতির নেতাদের দেখবেন, তারা জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।”

বাংলাদেশী ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম বলেন, “ যারা শিক্ষার্থীদের অধিকারের কথা বলবে, শিক্ষামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করবে, সেটাই মূলত ছাত্র রাজনীতি হতে পারে। কিন্তু লেজুড়বৃত্তির যে চর্চা, দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্য যে চর্চা, তার মধ্য দিয়েই আমাদের ছাত্র রাজনীতি যায় আসলে। সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী বলেছেন, ‘ছাত্র রাজনীতি একটা ইবাদত।’ ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা মনে করি, প্রত্যেকটা ভাল কাজ, ন্যায়ের পক্ষে থাকা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সেটাই আসলে ইবাদত।”

তিনি বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে রাজতন্ত্রই বেশি প্রয়োগ করা হয়। এজন্য সেখানে ওই অর্থে রাজনৈতিক দল বা সংগঠন কাজ করে না। তবে পশ্চিমা বিশ্ব, এশিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলে ছাত্র রাজনীতির কাঠামো রয়েছে। তাদের ভুল ধরার গণতান্ত্রিক দলগুলোর ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে। তারা সহশিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা যতটা তাত্ত্বিকভাবে বিবৃতি বা বক্তব্য দেই, বাস্তবে সেটা নড়বড়ে।”

ছাত্রদলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির বলেছেন, ‘ওনার দল যখন ক্ষমতায় আসবে, উনি তখন ছাত্র-বান্ধব অনেক কর্মসূচি গ্রহণ করবেন।’ অতীতে ছাত্রলীগ ক্ষমতায় থাকাকালে কেমন কর্মসূচি দিয়েছে, সেটা তো আমাদের কাছে স্পষ্ট। দল ক্ষমতায় আসলে আমি ছাত্রবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করব, এটার চেয়ে সংকীর্ণ বক্তব্য আর কি হতে পারে?”

“আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্য হলো এত বছর হয়ে গেলেও এ জাতি এখনও একটি জাতীয় আদর্শ ঠিক করতে পারেনি। আমরা যদি জাতীয় আদর্শ ঠিক করতে পারি এবং সেই আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারি, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আসবে। ক্যাম্পাসের সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ছাত্র-শৃঙ্খলা বিধি নামক একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই বিধিটি সকলে ব্যক্তিগতভাবে ও সামস্তিকভাবে মেনে চলতে হবে,”- যুক্ত করেন শিবির সম্পাদক।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সাধারণ সম্পাদক মেঘমল্লার বসু ছাত্র ইউনিয়নকে দলীয় লেজুড়বৃত্তিহীন সংগঠন দাবি করেন এবং ডাকসু গঠনতন্ত্রের বিদ্যমান ত্রুটিগুলোর সমালোচনা করেন। একটি সুষ্ঠু ও যুগোপযোগী রাজনীতির জন্য জন্য তিনি চারটি সংস্কারের কথা বলেন। এগুলো হলো- সিআর কাউন্সিল নির্বাচন, অনুষদভিত্তিক ডাকসু নির্বাচন, ডাকসুর গঠনতন্ত্রের আমূল পরিবর্তন এবং হলের সিট বন্টনের দায়িত্ব প্রশাসনের হাতে রাখা।

ডাকসুর সাবেক সমাজ সেবা সম্পাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক আখতার হোসেন বলেন, “ছাত্র রাজনীতি নিয়ে কেন শিক্ষার্থীদের ভয় রয়েছে, সে বিষয়ে আমাদের ভেবে দেখা উচিত। বিগত সময়ে ছাত্রলীগ যে র‍্যাগিং কালচার চালু রেখেছিল, তার ট্রমা এখনো কাটেনি। গত দেড় দশক ফোন থেকে দেখে চেক করে করে মারধর করার রাজনীতি দেখে আমরা বেড়ে উঠেছি। আমিই নিজের তার ভুক্তভোগী। দমননীতি, গেস্টরুম কালচার, মাদার সংগঠনের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়ার যে প্রবণতা সে জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।”

তিনি বলেন, “আজ ছাত্রদলের প্রতিনিধি নাসির ভাইয়ের এখানে আসার কথা ছিল। তিনি এখানে না এসে তারেক জিয়ার মিটিংয়ে গেছেন। এটাকে আমরা লেজুড়বৃত্তিকতা বলতে পারি কিনা, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।”

এর আগে, অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও বিতার্কিক রাফিয়া রেহনুমা হৃদি।

অনুষ্ঠানে পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহি ও ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক আদনান মোস্তারী।