বাংলাদেশে মাংস বা রেড মিটের চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেলেও সেই তুলনায় সরবরাহ অপ্রতুল। এর মধ্যে ছাগলের মাংস ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে উৎসব-পার্বণ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন খাবারে সবাই খেয়ে থাকেন। কিন্তু এ মাংসের দাম সবচেয়ে বেশি হওয়ায় অনেকের নাগালের বাইরে। এর মূল কারণ, চাহিদার তুলনায় সরবরাহের ঘাটতি।
দেশীয় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দিয়ে মাংসের এ বিপুল চাহিদা পূরণ করা সম্ভব না হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বিকল্প পথ খুঁজছিলেন বিজ্ঞানীরা। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক দক্ষিণ আফ্রিকার বোয়ার জাতের পাঠার সঙ্গে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগীর সংকরায়নের মাধ্যমে একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন, যা ব্ল্যাক বেঙ্গলের তুলনায় দ্বিগুণ মাংস উৎপাদনে সক্ষম। ব্ল্যাক বেঙ্গলের মতো একই পরিমাণ খাবার দিয়েই এ সংকর জাত থেকে দ্বিগুণ মাংস উৎপাদন সম্ভব।
এ জাত উদ্ভাবন করেছেন বাকৃবির পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রুহুল আমিন। তার সহযোগী গবেষক ছিলেন একই বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী খালিদ সাইফুল্লাহ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত ‘ডেভেলপমেন্ট অব মিট টাইপ ক্রস ব্রিড ইউজিং বোয়ার অ্যান্ড ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় তারা এ গবেষণা সম্পন্ন করেন। গবেষণাটি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নাল ‘জার্নাল অব অ্যানিমেল রিসার্চ’-এ প্রকাশিত হয়েছে ।
গবেষণায় দেখা গেছে, সংকর জাতের ছাগল জন্মের সময় গড়ে ২ কেজি ওজন নিয়ে জন্মায়, যেখানে দেশীয় ব্ল্যাক বেঙ্গলের বাচ্চার গড় ওজন মাত্র ৮০০ গ্রাম। এক বছরে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের যেখানে সর্বোচ্চ ওজন দাঁড়ায় ৮-১০ কেজি, সেখানে সংকর জাতটি ২৫ কেজিরও বেশি ওজন ধারণ করতে সক্ষম। এর রঙ সাদা-বাদামী বা কালো হওয়ায় জাতটি দেখতে বেশ আকর্ষণীয়।
ছাগলের এ জাত নিয়ে প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. রুহুল আমিন রাইজিংবিডির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, “বোয়ার জাতের ছাগলের উৎপত্তি দক্ষিণ আফ্রিকায়, যা মাংসের জন্যে বিশ্বখ্যাত। দুই বছরে সর্বোচ্চ ৭০ কেজি মাংস দিতে পারে। তবে এটি বাংলাদেশের জলবায়ুর সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই নয়। এ সমস্যার সমাধানে ব্ল্যাক বেঙ্গল ও বোয়ারের সংকর জাত উদ্ভাবন করা হয়। এ ছাগলের মাংসে চর্বিও কম হওয়ায় হৃদরোগের ঝুঁকি কমে, যা স্বাস্থ্যকর। নতুন এ জাতের পুরুষ ছাগল বছরে ২৬ কেজি এবং মাদি ছাগল ২৩ কেজি পর্যন্ত মাংস উৎপাদনে সক্ষম। এ জাতটি রোগ প্রতিরোধে শক্তিশালী এবং সহজে লালন-পালন করা যায়।”
তিনি আরো বলেন, “গবেষণার সময় দেখা গেছে, দৈনিক ১০০ গ্রাম করে ওজন বৃদ্ধি পাওয়া এ জাতটি সহজেই দেশের খামার ব্যবস্থাপনায় মানিয়ে নিতে সক্ষম। গবেষণার সময় এ সংকরের স্ত্রী বাচ্চাদের ১ বছর বয়সে মাত্র ৬ শতাংশের ডাকে এসেছিল। অন্যদিকে ব্ল্যাক বেঙ্গল পাঠীর ৬-৭ মাসেই প্রথম গর্ভধারণ করে। অর্থাৎ ব্ল্যাক বেঙ্গলের তুলনায় এই জাতীয় সংকর স্ত্রী বাচ্চাদের মা হতে প্রায় দ্বিগুণ সময় লাগে। এমন অবস্থায় ১ বছর বয়সে লিঙ্গ নির্বিশেষে সব সংকর যদি জবাই করে মাংস উৎপাদন করা হয়, তাহলে কৃষকের দ্বিগুণ লাভ হবে ব্ল্যাক বেঙ্গলের তুলনায়। স্ত্রী সংকর বাচ্চাগুলোকে আর প্রজনন করানোর প্রয়োজন নেই।”
চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে প্রধান গবেষক বলেন, “এ জাত নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বোয়ার জাতের ছাগলের খাবারের চাহিদা বেশি হওয়ায় এটি সম্পূর্ণ খাঁটি অবস্থায় বাংলাদেশের পরিবেশ ও খামার ব্যবস্থাপনার জন্য উপযোগী নয়। তবে ব্ল্যাক বেঙ্গলের সঙ্গে সংকরায়নের মাধ্যমে এ সীমাবদ্ধতা কাটানো সম্ভব হয়েছে।”
গবেষক আরো বলেন, “বাংলাদেশে জাতীয় প্রজনন নীতিমালায় শুধু ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল অনুমোদিত। ফলে সংকর জাতের ছাগল দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে সরকারি অনুমোদন একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে প্রতিবেশী দেশ থেকে বিভিন্ন জাতের ছাগল অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করছে, যা স্থানীয় প্রজাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বোয়ার ও ব্ল্যাক বেঙ্গলের সংকর জাতটি সহজেই স্থানীয় প্রজনন ব্যবস্থায় যুক্ত করা গেলে কৃষকেরা লাভবান হতে পারবেন। এটি শুধু মাংসের চাহিদা পূরণই করবে না, বরং কৃষকদের আয়ের নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। বাংলাদেশের মাংস শিল্পে এই উদ্ভাবন হতে পারে পরিবর্তনের এক স্থায়ী পথ।”
গবেষক খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো কম খরচে ভোক্তার কাছে গুণগত মাংস পৌঁছে দেওয়া। খামারিরা এ জাত পালন করে বছরে প্রায় দ্বিগুণ মুনাফা করতে পারবেন। কারণ, একই পরিমাণ খাবার ও পরিচর্যায় ব্ল্যাক বেঙ্গলের তুলনায় সংকর জাত থেকে দ্বিগুণ মাংস পাওয়া যায়।”