ক্যাম্পাস

বাংলাদেশ ও সিরিয়ার অভ্যুত্থান কি একই?

প্রত্যেক দেশের একটা নিজস্ব ভৌগলিক আবহাওয়া, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রভাব আছে। মানবদেহে যেমন জিনগত প্রভাব থাকে, তেমনি একটা জাতির মধ্যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রভাব থাকে। আর এ এতিহ্য ও সংস্কৃতিই মানুষকে এক দেশ থেকে অন্য দেশের সঙ্গে পার্থক্য করে। তেমনি দুটি দেশ বাংলাদেশ ও সিরিয়া।

২০২৪ সালে যেমন পৃথিবী দেখেছে একাধিক রাষ্ট্রের যুদ্ধবিধ্বস্ত ঘটনা, তেমনি দেখেছে কতিপয় রাষ্ট্রের অভ্যুত্থান। তার মধ্যে বাংলাদেশ ও সিরিয়া দুটি রাষ্ট্রেও অভ্যুত্থান হয়েছে। অনেক বিশ্লেষক ও গবেষকরা দুটি রাষ্ট্রের অভ্যুত্থানকে একই চোখে দেখছেন। কিন্তু এ অভ্যুত্থানকে একই বিচারে বিচার করা কতটা যৌক্তিক, তার একটা সমালোচনা করার প্রয়োজন। 

প্রাচীন থেকে আধুনিক পর্যন্ত যারা স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে সরকার বা দেশ পরিচালনা করত, তাদের প্রত্যেকেরই পতন হয়েছে। কিছু কর্মফলের ভোগ পৃথিবীতেই করতে হয়। তার একটি স্বৈরাচারের পতন ও ভোগান্তি। যারা রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম করেছে, তাদের প্রত্যেকেরই পতন হয়েছে। এটা শুধু ভারত উপমহাদেশ নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেই এমন বহু ঘটেছে। এটা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বড় একটি শিক্ষা।

বাংলাদেশের যে অভ্যুত্থান বা আন্দোলন তার প্রেক্ষাপট দেখলে বুঝা যাবে, কতটা পার্থক্য সিরিয়ার অভ্যুত্থানের সঙ্গে। গত ৫ জুন উচ্চ আদালতে কোটা বাতিল নিয়ে রিট বহালের আদেশ দিলে সেখান থেকেই শুরু হয় আন্দোলন। ক্রমান্বয়ে তা ধীরে ধীরে রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে।

৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন হয়। শিক্ষার্থীরা ৯ জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারকে সময় বেধে দেন। দাবি পূরণ না হলে সর্বাত্মক আন্দোলনের হুমকি দেন। মাসব্যাপী আন্দোলন চলমান ছিল। পরে ২ জুলাই আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নামেন এবং ৩ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কতিপয় বিশ্ববিদ্যাময়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করেন। ৬ জুলাই বাংলাদেশের  ইতিহাসে নতুন শব্দ যুক্ত হয় ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে।

৭ জুলাই থেকে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের  ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন। ৮ জুলাই ঢাকার ১১ স্থানে অবরোধ, নয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ, তিনটি স্থানে রেলপথ ও ছয়টি মহাসড়ক অবরোধ করেন। ১২ জুলাই  চট্টগ্রাম ও কুমিল্লাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশি হামলা হয়। ১৩ জুলাই রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেন শিক্ষার্থীররা। ১৪ জুলাই  প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনরত  শিক্ষার্থীদেরকে রাজাকার বললে আন্দোলন আরো বেগবান হয়।

১৬ জুলাই ছিল কাল অধ্যায়। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহীদ হন। চট্টগ্রামেও শহীদ হন ওয়াসিমসহ অনেকেই। ১৮ জুলাই  বিজিবি ও সেনা মোতায়েন করে সরকার। ১৯ জুলাই কমপ্লিট শাট ডাউন ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা এবং সরকার কারফিউ দেন। ২১ জুলাই আদালতে রায় আসে মেধাভিত্তিক ৯৬ শতাংশের। কিন্তু তাতেও আন্দোলন থামেনি।

এতো শিক্ষার্থীদের হত্যার জন্য আন্দোলনকারীরা আরো চাপ দেন সরকারকে। সরকারও আন্দোলনকারীদের উপর চড়াও হয়ে ২১ দিনে ৪৩৫ জনকে হত্যা করে। ৩ ও ৪ আগস্টে এক দফা দাবি নিয়ে সরকার পতনে নামেন শিক্ষার্থীরা এবং ৫ আগস্ট সরকার পতন হয়। আগস্টে সর্বাধিক  শিক্ষার্থী শহীদ হন। ১ থেকে ৫ আগস্টে শিক্ষার্থী, শিশু, নারীসহ নানা পেশার মানুষ শহীদ হন।

অপরদিকে, সিরিয়ার যে অভ্যুত্থান তা প্রায় ১৩ বছর ধরে চলমান। আর বাংলাদেশে প্রায় দুই মাস।  ২০১১ সালে আরব বসন্তের মাধ্যমে সিরিয়াতেও বিদ্রোহ দেখা দেয়। এরই ফলশ্রুতিতে প্রায় ৫ দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা আসাদ পরিবারের ক্ষমতা শেষ হয়। তাদের দেশে বিদ্রোহীরা সেই অভ্যুত্থান ঘটান। হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতৃত্বে সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি, ন্যাশনাল লিবারেল ফ্রন্ট, আহরার আল-শাম, ফ্রি সিরিয়ান আমি, সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসসহ কতিপয় বিদ্রোহ গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়ে ২৭ নভেম্বর আকস্মিক অভিযান চালান।

২৮ নভেম্বর আলেপ্পা দখল, ৫ ডিসেম্ব থেকে ৮ ডিসেম্বর রাজধানী দাসেস্কসহ বিভিন্ন এলাকা দখলে নেন। এ পুরো অভিযানের নেতৃত্ব দেন আবু মোহাম্মদ আল জোলানি। তার প্রকৃত নাম আহমেদ হুসাইন আল-শারা। ১৩ বছরে সিরিয়ায় প্রায় ৬ লাখ মানুষ নিহত হন এবং প্রায় কোটিরও অধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হন, যা বাংলাদেশের আন্দোলনের সঙ্গে কোনভাবেই সমান নয়।

১৯৭১ সাল থেকে আসাদ পরিবার সিরিয়াকে শাসন করে আসছে। হাফিজ আল আসাদের পর ক্ষমতায় বসেন তার ছেলে বাশার আল-আসাদ। অন্যদিকে ১৯৭২ থেকে ৫০ বছরে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এরশাদসহ নিরপেক্ষ সরকারও দেশ শাসন করেছে। গত ১৫ বছরে আওয়ামীলীগ টানা ক্ষমতায় থেকে যা করেছে, তাতেই মানুষ স্বস্তিতে ছিল না। সেখানে টানা ৫০ বছরে সিরিয়ার মানুষ কীভাবে ছিল তা সহজেই অনুমেয়। সেদিক থেকে তাদের আক্ষেপটা বেশি।

বাংলাদেশ থেকে কোন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়নি। তবে গুম, খুন, হত্যার শিকার হয়েছে, যা সিরিয়াতেও ছিল। সিরিয়ায় মানুষের জীবন যাপন স্বস্তিতে ছিল না। বছরের পর বছর ধরে আসাদের দূর্বল শাসন, অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত ছিল। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ততটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। সিরিয়ার শাসক বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় ছিল রাশিয়া ও ইরানের মদদপুষ্ট হয়ে। বাংলাদেশের সরকার হাসিনা ছিল মোদি মদদপুষ্টে। তাছাড়া বাংলাদেশের অভ্যুত্থান হয় শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে, আর সিরিয়ার হয় বিদ্রোহীদের মাধ্যম।

এইচটিএসসহ বাকি বিদ্রোহীরাও সন্ত্রাসী তালিকার অন্তর্ভুক্ত। সিরিয়া জন্মগতভাবেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। তাদের মধ্যে রক্তের ঘ্রাণ সব সময় লেগে থাকে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের অভ্যুত্থান শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে, যা ছিল শান্তিপূর্ণ। হাজারো নিরীহ নিরস্ত্র শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে, সিরিরা অস্ত্রধারী বিদ্রোহীদের দ্বারা প্রায় বিনা রক্তপাতে স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে।

যদিও দুটি দেশেরই মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বৈরাচামুক্ত হওয়া। কিন্তু স্বৈরাচার মুক্ত হওয়ার পিছনে যে করুণ ইতিহাস বা প্রেক্ষাপট, তা ছিল ভিন্ন। ফলে বাংলাদেশের স্বৈরাচার মুক্ত আন্দোলনের সঙ্গে সিরিয়ার স্বৈরাচারমুক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটকে একই পাল্লায় এনে মাপা বা একই কাটগড়ায় বিচার করা কখনোই যৌক্তিক হবে না।

লন্ডন ভিত্তিক প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের তালিকায় বাংলাদেশে হয়েছে প্রথম (চ্যাম্পিয়ন) ও চব্বিশের সেরা দেশ। যদিও সিরিয়া হয়েছে রানার্স আপ বা দ্বিতীয়। আমাদের দেশ থেকে তাদের দেশের মানুষ রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বেশি সমস্যার ছিল। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে প্রথম করার কারণ হলো- তারা নিরস্ত্র, শিক্ষার্থী, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সংস্কারের জন্য; ক্ষমতার জন্য নয়।

সিরিয়া দ্বিতীয় হওয়ার কারণ, অভ্যুত্থান হয়েছে বিদ্রোহী, অস্ত্রধারী, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের মাধ্যমে। তাই বাংলাদেশের অভ্যুত্থানকে সিরিয়ার অভ্যুত্থানের সঙ্গে একই কাতারে রাখা কখনোই উচিত নয়।

(লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)