করোনার সংক্রমণ রোধে বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট-পিপিই), টেস্টিং কিটসহ কয়েকটি পণ্যের সংকট রয়েছে। দেশে এসব পণ্য উৎপাদনের জন্য বাইরে থেকে কাঁচামাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এরপর পণ্যগুলো উৎপাদিত হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি সম্ভব হবে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন নতুন পথের সন্ধান করতে হবে বলে মনে করছেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত বুধবার (২৫ মার্চ) অনুমোদন দেওয়ার পর এরইমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে কয়েক লাখ পিপিই তৈরির কাজ পুরোদমে চলছে পাঁচটি কারখানায়। আরও এক ডজন কারখানা সুরক্ষা পোশাক তৈরি শুরু করবে এক সপ্তাহের মধ্যে।
বিজিএমই, অরুণাচল ট্রাস্ট, বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা চেইন শপ মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন –এই পাঁচ প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে পিপিই তৈরির বড় পদক্ষেপটি নিয়েছে। তাদের যৌথ উদ্যোগে পাঁচটি গার্মেন্টস উর্মি গ্রুপ, স্নো টেক্স, আমান গ্রুপ, ডেকো গ্রুপ এবং স্মার্টেক্স গ্রুপ বুধবার থেকে পিপিই উৎপাদন শুরু করেছে। তারা কমপক্ষে পাঁচ লাখ সুরক্ষা পোশাক তৈরি করবে। এই পাঁচ গ্রুপটি বর্তমানে ব্যস্ত সময় পার করছে। কারণ অনেক হাসপাতাল ও ব্যাংক পিপিই ক্রয়াদেশ দিয়ে রেখেছে তাদের।
এছাড়া চট্টগ্রামের ইপিজেডে স্মার্ট জ্যাকেট আগে থেকেই পিপিই রপ্তানি করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি আপাতত রপ্তানি বন্ধ করে দেশের জন্য পিপিই তৈরি করছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এক লাখ পিপিই’র ক্রয়াদেশ দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানকে। এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ৫০ হাজার পিপিই সরকারকে বুঝিয়ে দিয়েছে। এই চট্টগ্রাম ইপিজেডে মোস্তফা গ্রুপ তৈরি করছে উন্নত মাস্ক। চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে প্রতিষ্ঠানটি ১০ লাখ মাস্কের ক্রয়াদেশ পেয়ে উৎপাদনে ব্যস্ত। তারা এখন রপ্তানির চিন্তা করছে। এছাড়া দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড ওয়ালটন পিপিই ও সেনিটাইজার তৈরি করে বিনামূল্যে বিতরণ করতে যাচ্ছে।
হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান এবং অ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি চালকদের জন্য মূলত এই পিপিই তৈরি হবে। সরকারি তথ্য মতে, আগামী তিন মাসের জন্য পিপিইর সর্বোচ্চ চাহিদা থাকতে পারে ১০ লাখ পিস। বিজিএমইএ জানিয়েছে, তারা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই সরকারকে এক লাখ পিপিই উপহার দিয়েছিল। আগামী শনিবার আরও ৫০ হাজার পিপিই দিতে পারবে, বিনামূল্যে দেওয়া হবে এসব চালান।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার সাড়ে তিন লাখ পিপিই সংগ্রহ করে বিভিন্ন হাসপাতালে বিতরণ করেছে। চীনের ১০ হাজার পিস পিপিই ও কিটের চালান আসার পর মজুদ আছে আরও ৬০ হাজার পিস পিপিই। এ মাসেই বিভিন্ন দেশ থেকে আরও এক লাখ পিস পিপিই দেশে আসবে। আগামী তিন মাসে ১০ লাখ পিপিইর প্রয়োজন হবে।
এ বিষয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা হয় বিজিএমই, বিকেএমইএসহ পোশাক খাতের শীর্ষ আটটি অ্যাসোসিয়েশনের জোট রেডিমেড গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল স্কিলড কাউন্সিলের। ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান জিএম ফারুক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পিপিই, গাউন, মাস্ক, গ্লাভস, অ্যাপ্রন তৈরি হওয়ায় সঙ্কট মুহূর্তে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানাকে জন্য স্বস্তির। সামনের দিনে করোনার প্রকোপ থাকবে না, কিন্তু বিশ্ববাসীকে কাপড় কিনতে হবে। আমাদের অনেক বছরের দক্ষ হাতের কাপড় ইচ্ছে করলেই এতো কম দামে তারা পাবে না। তবে এ সময় নিস্তার দেবে নতুন এসব পণ্য। এ সময়ের মধ্যে আমাদের করোনার প্রভাব কাটিয়ে ওঠার পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।’
বিকিএমইর এই পরিচালক বলেন, ‘যাদের ক্রয়াদেশ আছে, সেসব কারখানাকে আইইডিসিআরের বিধি মেনে শ্রমিকদের সুরক্ষা দিয়ে উৎপাদন চালিয়ে যেতে হবে। অন্যান্য কারখানাগুলোর পিপিএসহ নতুন পণ্য উৎপাদন করে নতুন রপ্তানির বাজার ধরার সুযোগ রয়েছে। আর সরকার জাইকার মতো প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ঋণ নিয়ে মালিকদের দিলে আরো গতি নিয়ে করোনার পরের পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে পুরনো পণ্য ও নতুন পণ্য দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও আছে বাংলাদেশের। ’
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় সারাবিশ্বে কয়েকটি জিনিসের চাহিদা থাকবে। সেগুলো হলো- পরীক্ষা করার টেস্টিং কিট, হাত পরিষ্কার রাখার দ্রবণ, মুখ ঢাকার সরঞ্জাম, অ্যাপ্রন, গাউন, গ্লাভস, ম্যাডিকেল মাস্ক, চশমা, রেস্পিরেটর এবং কাস্তে রাখার যন্ত্র। এগুলোর মধ্যে কেবল শ্বাস নেওয়ার যন্ত্র রেস্পিরেটর বা ভেন্টিলেটর ছাড়া বাকিগুলো বাংলাদেশ বানানোর সামর্থ্য রাখে। এমনকি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের করোনাভাইরাস টেস্টিং কিটও রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও তা নির্ভর করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এ কিটের মানের স্বীকৃতি দেওয়ার ওপর।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বৃহস্পতিবার বলেন, সরকার কাঁচামাল আমদানির অনুমতি দেওয়ায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত টেস্টিং কিটের কাঁচামাল বিদেশ থেকে চলে এসেছে। ১০ এপ্রিল স্যাম্পল উৎপাদন করে আমরা সরকারের কাছে জমা দিতে পারবো। চূড়ান্ত অনুমতি দিলে এপ্রিলেই এক লাখ কিট উৎপাদন করা সম্ভব। কম সময়ে ফলাফল পাওয়া যায় বলে এবং বর্তমানে ব্যবহৃত কিটের দাম প্রতিটি ১৫ হাজার পড়লেও আমাদেরটা তিনশ টাকা দাম হওয়ায় এরইমধ্যে সারাবিশ্ব থেকে যোগযোগ শুরু হয়েছে। দেশের চাহিদা পূরণ করে আমরা মে থেকে রপ্তানি করতে পারবো। ’
সরকারের বিআইডিএসের অর্থনীতিবিদ ড. নাজনিন আহমেদ করোনোভাইরাস মহামারির পর ‘নতুন বিশ্ব’ ও ‘নতুন সম্ভাবনা’র কথা জানিয়ে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘করোনা পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি হবে অন্যরকম। সেক্ষেত্রে আমরা পিপিই উৎপাদন ও রপ্তানি করার কথা ভাবতে পারি। তাছাড়া আমাদের কেমিক্যাল শিল্প স্যানিটাইজার তৈরির চিন্তাভাবনা করতে পারে। আসলে করোনাভাইরাস বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন দ্বার খুলতে পারে।’
ঢাকা/সাজেদ/জেডআর