অর্থনীতি

ওয়ালটনের জায়ান্ট ফ্যাক্টরি: ছবির মতো সাজানো শিল্পনগর

২০১৯ সালের ২ মে। বৃহস্পতিবার। পেশাগত জীবনের মোড় ঘুরে গেল। এর আগের পুরো সপ্তাহ জুড়ে অনেক ভেবেছি। সাংবাদিকতা ছাড়বো কি ছাড়বো না- এ নিয়ে। সাংবাদিকতায় খারাপ করছিলাম না। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। ওই সুযোগগুলো সময়মতো কাজেও লাগিয়েছি ঠিকঠাক। নিজেকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা ছিলো সবসময়ই। যেখানেই গিয়েছি একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করেছি।

বুধবার ওয়ালটনের এইচআরএম বিভাগের ফোনকল। ‘...আপনি আগামীকাল (২ মে) আমাদের ক্রিয়েটিভ অ্যান্ড পাবলিকেশন বিভাগে জয়েন করছেন, কোনো সমস্যা নেই তো?।’ এর কয়েকদিন আগে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গিয়েছিল। সময়টা জেনে নিয়ে উত্তর দিলাম, ‘কোনো সমস্যা নেই, ধন্যবাদ।’ অমনি চারটে শব্দে জীবনের মোড় ঘুরে যায়! সাংবাদিকতা ছেড়ে করপোরেটের অচেনা ভুবনে এলাম।

ভালোভাবে পরিচয় হতে থাকে করপোটে কালচারের সঙ্গে। আরো ভালো করে জানার সুযোগ হয় কিভাবে একটি আদর্শ করপোরেট অফিসের সুবিশাল মিডিয়া বিভাগ পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের করপোরেট জগতের শ্রেষ্ঠ মিডিয়া বিভাগ ওয়ালটনের। কর্মযজ্ঞে, কোয়ালিটিতে, পরিধিতে কিংবা জনবলে। সব ক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। মনে হয় এটাও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মাল্টিমিডিয়া সমৃদ্ধ সাংবাদিকতা বিভাগ, যেখানে প্রযোজ্য সবকিছুই বিদ্যমান।

এমন এক বিভাগে জয়েন করেছি যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন লেখক, সাংবাদিক ও উপস্থাপক উদয় হাকিম স্যার। তার সঙ্গ পাওয়া যে কোনো মাসমিডিয়া প্র্যাকটিশনারের জন্য সৌভাগ্যের। তার হাতে প্রতিনিয়ত শিখছি। অসাধারণ তার এডিটিং স্কিল! সকালে অফিসে আসতেই ওয়ালটনের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর অগাস্টিন সুজন দাদা বললেন, ‘প্রথম দিনই আপনি ওয়ালটনের কারখানা দেখার সুযোগ পেয়েছেন। ওয়ালটন সম্পর্কে আরো ভালো জানতে পারবেন। ওয়ালটন সম্পর্কিত আগের অনেক ধারণাও পরিবর্তিত হবে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন আজ ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে যাবেন। সেই প্রোগ্রাম কাভার করতেই যাচ্ছি আমরা।’

৯টার দিকে ফ্যাক্টরিতে পৌঁছে গেলাম। ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। বাংলাদেশে ইলেক্ট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইলস পণ্যসমূহ এবং অন্যান্য অ্যাপ্লায়েন্স তৈরির বৃহত্তম কারখানা এটি। প্রধান ফটক পেরিয়ে যত ভেতরে প্রবেশ করছি ততই চোখ ছানাবড়া অবস্থা! ও মাই গড! এতো বড় ফ্যাক্টরি আমার দেশে! অকল্পনীয়! ভেতরে প্রবেশ করার পর মনেই ছিল না আমি বাংলাদেশের কোনো ফ্যাক্টরি দেখছি। আই সয়্যার! এটা সত্যি বলছি।

হুলস্থুল কাণ্ড! অর্ধশতাধিক সাংবাদিক! ক্যামেরা! ফোকাস! জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন কারখানায় পৌঁছলে তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান এস এম নূরুল আলম রেজভী এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম আশরাফুল আলম স্যার সহ কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তারা। আমি চারপাশ দেখছি-শুনছি। দেখে-শুনে শেখা-ই সেসময়ে আমার কাজ।

গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর একাংশ। ছবি: রাজীব আহমেদ।

ওয়ালটন কারখানাটির সম্পূর্ণ আয়তন সাড়ে সাতশ একরেরও বেশি! গাজীপুরের চন্দ্রায় অবস্থিত ওয়ালটনের এই জায়ান্ট ফ্যাক্টরির ভবনগুলোর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০২ সালে। সম্পন্ন হয় ২০০৬ সালে। পণ্য উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৮ সালে। ভেতরে বিশালাকার চওড়া একেকটা রাস্তা। রাস্তার দুধারে নানা প্রজাতির সুন্দর সব গাছ-গাছালি। চোখে পড়বে বিশালাকার লেক। দেখা যাবে বড় বড় পুকুরও। লেকের পরিস্কার পানিতে মাছগুলোর নড়াচড়াও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রাস্তাগুলো এতো পরিপাটি আর পরিচ্ছন্ন যে হাত থেকে রুটি পড়ে গেলে কুড়িয়ে খাওয়া যায় নির্দ্বিধায়। মনে এলো, ‘কনজার্ভেশন অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড পল্যুশন কন্ট্রোল’ ক্যাটাগরিতে এমনি এমনি জাতীয় পরিবেশ পদক পায়নি এ কারখানা।

বিশালায়তনের একেকটি ভবন। প্রত্যেকটি ভবনে যাওয়া-আসার জন্য আছে চওড়া রাস্তা। কোনোটিতে উৎপন্ন হচ্ছে মেইড-ইন-বাংলাদেশ ট্যাগযুক্ত রেফ্রিজারেটর, কোনোটিতে এয়ার কন্ডিশনার, কোনোটিতে কম্পিউটার-ল্যাপটপ। কোনো ভবনে উৎপন্ন হচ্ছে কম্প্রেসর। নির্দিষ্ট কোনো ভবনে উৎপন্ন হচ্ছে বিশ্ব মানের টেলিভিশন কিংবা হোম ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স। কোনোটাতে তৈরি হচ্ছে মোবাইল হ্যান্ডসেট। কোনো ভবনের উৎপাদিত পণ্য অপেক্ষমান রপ্তানির জন্য। কোনো ভবনের সামনে পণ্যবাহী গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শোরুম বা আউটলেটগুলোর উদ্দেশ্যে ছুটে চলার জন্য।

এখানেই শেষ নয়! প্রতিমন্ত্রী এসব ভবন পরিদর্শনে যাচ্ছিলেন। সামনে পেছনে সুসজ্জিত গাড়ির বহর। আমারও সুযোগ হয়েছিল গাড়িবহরের সঙ্গী হওয়ার। দারুণ লেগেছিল ওয়ালটন কারখানায় সাজানো গাড়ি দেখে। এসব গাড়ি সচরাচর বাইরে দেখা যায় না। অর্ধ শতাধিক গাড়ি সাজানো রয়েছে মন্ত্রী এবং তার সঙ্গীদের একেকটি ভবন পরিদর্শনের জন্য। গাড়িগুলোর কি বাহারি রঙ-ঢং! চলেও দারুণ! প্রতিটি ভবনের একদিক দিয়ে প্রবেশ করে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যাবার পথও আকর্ষণীয়। সেভাবেই নির্মাণ করা হয়েছে এসব কারখানা। এ যেন নিখুঁত আর সুপরিকল্পিত এক সুবৃহৎ শিল্পনগর। সম্প্রতি কারখানা পরিদর্শনের পর অভিনেতা আজিজুল হাকিম এই কারখানাকে ‘একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিলেজ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যথার্থই। ফরহাদ হোসেনের আগে-পরে অনেক হেভিওয়েট মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ওয়ালটনের কারখানা পরিদর্শনে গিয়েছেন। যতবার গিয়েছি ততবারই ওই গাড়িগুলোতে উঠেছি। গাড়িতে করে কারখানা দেখা এখন ভালোলাগায় পরিণত হয়েছে। এ পর্যন্ত এক ডজনেরও বেশি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সরকারি-বেসরকারি নামি দামি ব্যক্তি ওই কারখানা পরিদর্শনে গিয়েছেন।

একে একে ফ্রিজ, কম্প্রেসর, এসি, কম্পিউটার, টিভি ও মোবাইল ফোন, এলিভেটর, জেনারেটর, ওয়াটার পাম্প, ওয়াশিং মেশিনসহ সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন ও প্যাকেজিং প্রক্রিয়া সরেজমিনে দেখলাম। গত এক দশকের মাথায় ওয়ালটনের উন্নতি সত্যিই প্রশংসনীয়। একই সঙ্গে ঈর্ষণীয়ও বটে। ২০১০ সালের দিকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি তখন ওয়ালটনের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে নজরে আসে। সেসময় টিভি-সংবাদপত্র-সাইনবোর্ড সর্বত্র একটা বিজ্ঞাপনবার্তা দেখা যেতো- ‘ওয়ালটন, আমাদের পণ্য’ (Walton, it's our product)। এই ৩টি বাংলা ও ৪টি ইংরেজি শব্দ ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অনেক টানতো। শব্দগুলোতে যেন দেশপ্রেম, ভালোবাসা আর নিজস্বতা আছে। আছে মানুষের মধ্যে দেশাত্মবোধ সৃষ্টির যাদুমন্ত্র!

আমার দীর্ঘদিনের প্রশ্ন- ওয়ালটনের এতো সাফল্যের পেছনের কারণ কি? কারখানা পরিদর্শনের পরেই বুঝেছি আসল রহস্য। সবধরনের ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদন ক্ষমতাই ওয়ালটনকে এ সাফল্য এনে দিয়েছে। পাশাপাশি গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী নতুন পণ্যের কাস্টমাইজড ওরিয়েন্টেশনের ভ্যারিয়েশনও ওয়ালটনকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। গ্রাহকের ভালোবাসা পেতে এ দুটি বিষয়ে সবচে বেশি কাজ করছে ওয়ালটনের ক্ষেত্রে। সব পণ্যের জন্য রয়েছে আরঅ্যান্ডডি বিভাগ। এই বিভাগটি পণ্যের গুণগত মান বিশ্লেষণ করছে প্রতিনিয়ত। যোগ করছে নতুন নতুন সব ফিচার। এসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স বাজারে বিপ্লব সৃষ্টি করে চলেছে ওয়ালটন। ২০১০ থেকে ২০২০। আমি বলবো, এই দশককে তাই বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স জগতের বিপ্লবের দশক বলা যায়।

সরেজমিনে কারখানার বিভিন্ন ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, পণ্য উৎপাদনে বিশ্বমানের যন্ত্র বা যত্রাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে ওয়ালটন কারখানায়। এসবের মধ্যে রয়েছে- থার্মোফর্মিং, চ্যানেল এক্সট্রুশন, এবিএস বা এইচআইপিএস সিট এক্সট্রুশন, ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ এক্সট্রুশন, পিপি হলো সিট এক্সট্রুশন, ভিএমসি, ৫ এক্সিস ভিএমসি, আল্ট্রাসোনিক ওয়েল্ডিং, ইনজেকশন মোল্ডিং, স্টাইরোফোম মেকিং, হাই স্পিড পাওয়ার প্রেস, ফিন প্রেস, করুগেশন, এসএমটি পিক অ্যান্ড প্লেস, এসপিজি প্রিন্টিং মেশিন, এওআই মেশিন, তামুরা ওয়েভ সোলডার মেশিন, অটো ইনসার্শন মেশিন ইত্যাদি।

নন-থ্যালেট প্লাস্টিসাইজারে তৈরি হচ্ছে ফ্রিজের দরজায় ব্যবহৃত গ্যাসকেট, গ্যাসস্ট্রিপ ও ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ। তৈরি হচ্ছে ফ্রিজের ক্যাবিনেট, ড্রয়ার ও অভ্যন্তরীণ সেলফ বা তাকসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য যন্ত্রাংশ। রয়েছে বিশাল স্টিল, জিংক, অ্যালুমিনিয়াম ও কপার কাস্টিং এবং ফাউন্ড্রি। আছে বিশাল টেস্টিং ও মেটাল প্রসেসিং সিস্টেম এবং আরঅ্যান্ডডি (গবেষণা ও উন্নয়ন) বিভাগ।

ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রোডাক্ট ডিসপ্লে সেন্টারে লেখক। ছবি: মো. লিটন।

এসব দেখে মন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন সেদিন। আর আমি ছিলাম কল্পনায়। উন্নত দেশের কোনো কল্পনার শিল্প নগরে। ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ফ্রান্স ভ্রমণের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। ফ্রান্সের পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ আর সুন্দর ঘর-বাড়িগুলোকে ছবির সঙ্গে তুলনা করেছেন তিনি। সেখানকার পরিচ্ছন্ন পরিবেশকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন সুনীল। ওয়ালটন ফ্যাক্টরিতে গিয়ে তেমন ভাবনা এলো আমার মনেও- কোনো ছবির নগরে এলাম নাতো!

প্রত্যক্ষ করলাম ওয়ালটনের কারখানায় তৈরি হচ্ছে বিশ্বের লেটেস্ট প্রযুক্তির কপ্রেসর। এই কম্প্রেসর কারখানা দেখে চক্ষু চড়কগাছ! ওই দিনই জানতে পারি, ৬ এপ্রিল, ২০১৭ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ওয়ালটনের কম্প্রেসর উৎপাদন কারখানা উদ্বোধন করেছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর এখন শুধু বাংলাদেশেই উৎপাদিত হয় এই কম্প্রেসর। ওয়ালটনের কম্প্রেসর কারখানা চালুর মধ্য দিয়ে বিশ্বে ১৫তম এবং এশিয়ায় ৮ম কম্প্রেসর উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে আসে কম্প্রেসর তৈরির ইতিহাসের পাতায়। খেল এখানেই খতম! না। ২০১৪ সাল থেকে এলিভেটর উৎপাদন করছে ওয়ালটন! এলিভেটর তৈরিতে ওয়ালটন অনুসরণ করছে ইউরোপীয় প্রযুক্তি ও মান। বাণিজ্যিকভাবে এলিভেটর বিক্রি করছে এ প্রতিষ্ঠানটি।

কথা হয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে। বললেন, এলিভেটর তৈরিতে ইউরোপীয় নিরাপত্তা কোড-ইএন ৮১-২০, ইএন ৮১-৫০ এবং ইএন ৮১-৭০ অনুসরণ করছে ওয়ালটন। একসময় আমার ধারণা ছিলো ওয়ালটনতো অ্যাসেম্বলিং করে। অনেকেই কিন্তু এই ভুল ধারণা নিয়ে আছেন এখনো। প্রথম দিন করাখানায় গিয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখেই সে ভুল ভেঙ্গে যায়। এই প্রথম টের পাই, পূর্ণাঙ্গ ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানা স্থাপনের সামর্থ পুরোপুরি রয়েছে বাংলাদেশের। আর ওয়ালটন তা প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছে ইতোমধ্যেই।  

২০২৫ সালের মধ্যে এক কোটি কম্প্রেসর উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ওয়ালটন! বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল হত-দরিদ্র দেশে এও সম্ভব! কারখানা দেখে সবিস্ময়ে চোখ খুলে গিয়েছিলো সেদিন! সদিচ্ছা, একাগ্রতা আর মেধা খাটাতে পারলে পাথরেও যেন ফুল ফোটানো যায়! তার প্রমাণ দিয়ে চলেছে ওয়ালটন।

এই প্রথম জানলাম, বাংলাদেশের কোম্পানি ওয়ালটন বিশ্বের ৪০টিরও অধিক দেশে পণ্য রপ্তানি করছে। যার মধ্যে রয়েছে ভারত, ইরাক, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, নাইজেরিয়া, পশ্চিম আফ্রিকা সহ বিভিন্ন দেশে। ওয়ালটনের পণ্য যাচ্ছে আমেরিকা বাজারেও! যাচ্ছে ইউরোপিয়ানদের বিশাল মার্কেট জার্মানি এবং পোল্যান্ডে! রপ্তানি হচ্ছে মধ্য প্রাচ্যের দেশ ইরাকেও। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিধিত্ব করতে কাতার, চীন, থাইল্যান্ড, নেপাল, ভারত, জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে ওয়ালটনের শাখা অফিস।

যুবক জুলহাস। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে। ওয়ালটনের কারখানায় কাজ করছেন প্রায় ১০ বছর ধরে। ওয়ালটন ফ্রিজের ডোর কেবিনেট এবং গ্যাসকেট উৎপাদন সেকশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত টিম লিডার তিনি। বলছিলেন, ওয়ালটন একটি কর্মী-বান্ধব প্রতিষ্ঠান। কোম্পানি অনেক সুবিধা দেয় আমাদের। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমাদের পরিশ্রমের মূল্য দেয় ওয়ালটন। এতে আমাদের কাজের আগ্রহ বেড়ে যায় অনেক গুণে। একই রকম কথা বললেন একই সেকশনে কর্মরত সুমন সরকার। ওয়ালটন কারাখানায় একটানা প্রায় ৯ বছর ধরে চলছে তার কাজ। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থেকে আসা এই কারখানাকর্মী জানালেন, অনেক জবের অফার থাকলেও ওয়ালটন কারখানায়ই থাকতে চাই। এখানকার মতো সুন্দর কর্মপরিবেশ কোথায় পাবো- প্রশ্ন সুমনের।

কারখানার কিউসি বা কোয়ালিটি সেকশনে কর্মরত সোহাগ রহমান একান্ত আলাপচারিতায় জানান, তাদের জন্য কারখানায় সার্বক্ষণিক মেডিক্যাল টিম রয়েছে। কোনো সমস্যা হলে প্রাথমিকভাবে তারাই চিকিৎসা দেন কর্মীদের। এছাড়া উন্নত চিকিৎসা লাগলে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেক্ষেত্রে সব খরচ বহন করে কোম্পানি।

ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানায় ‍ফ্রিজ উৎপাদন কার্যক্রম। ছবি: মো. লিটন।

শফিকুল ইসলাম এবং ইমন আহমেদ কর্মরত কারখানার ফায়ার সেকশনে। তারা জানান, প্রায় ১১০ জন লোক কাজ করেন এই সেকশনে। আরও লোক নিয়োগের পরিকল্পনা চলছে। নিরাপত্তার সবধরণের ব্যবস্থাই রয়েছে এখানে। আছে অগ্ননির্বিাপক বিভিন্ন সরঞ্জাম। এর মধ্যে রয়েছে হোসপাইপ বক্স, গংবেল, ফায়ার সাইরেন, ফায়ার বাকেট, বাকেট স্টেন, ষ্ট্রেচার, ফায়ার হুক, গামবুট, ডাস্ট মাস্ক, গ্যাস মাস্ক, সেইফটি গগলস, ফায়ার বাংকেট, লক কাটার, ফায়ার বিটার, স্মোক ডিটেক্টর, এক্সিট লাইট বক্স, ইমারজেন্সি এক্সিট লাইট বক্স, লাঞ্চ বেল ইত্যাদি।

প্রশ্নাতীতভাবেই অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়াই হবে কারখানা বা শিল্পের ঠিকানা। এখান থেকে (২০২০) চার বছর পেছনে গেলাম। ২০১৬ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়- ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ৪ ভাগের ১ ভাগ বাস করবে দক্ষিণ এশিয়ায়!...এ অঞ্চলে প্রতি মাসে ১০ লাখ নতুন মুখ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে!’

South Asia’s Turn: Policies to Boost Competitiveness and Create the Next Export Powerhouse’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘South Asia has tremendous potential to increase incomes and gain market share in exports through policies that enhance productivity and investment. If the region harnesses its productivity potential, it could be the fastest growing exporting region, for instance, tripling its share in global exports of electronics and motor vehicles by 2030.’

প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বিশ্বের পরবর্তী উৎপাদন ও রপ্তানির পাওয়ারহাউজে পরিণত হতে দক্ষিণ এশিয়া তার ওই ‘ডায়নামিক ডেমোগ্রাফি’র সুবিধাটা কাজে লাগাতে পারে।...আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃস্থানীয় শিল্পকারখানাগুলো ব্যাপক সম্ভাবনাময়। মনে হয়েছে, এ প্রতিবেদনের প্রতিটি কথাই বাস্তব করে তুলছে বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশ হবে এই অঞ্চলের রপ্তানির পাওয়ারহাউজ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এক ধাপ এগিয়ে দিচ্ছে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ওয়ালটন। ওয়ালটনের কারখানা পরিদর্শনের পর এই ভাবনা যে কারো মনে আসবেই।

মনে হয়েছে- ওয়ালটন নিয়ে ওয়ালটনের ক্রিয়েটিভ বিভাগ সৃষ্ট ট্যাগ ‘ইলেকট্রনিক্স জায়ান্ট ওয়ালটন’ কথাটি একদম খাঁটি। এই ট্যাগটি যে নির্ভুল, যে কেউ ওয়ালটনের ফ্যাক্টরিতে প্রবেশ করলে সহজেই বুঝবে। ওয়ালটনের ‘মাল্টিন্যাশনাল’ ট্যাগটিও তেমনি নির্ভুল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের শুরুর দিকে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ৩০টি দেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে’। এদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সেরা ৫টি ব্র্যান্ডের একটিতে পরিণত হওয়ার টার্গেট ওয়ালটনের। কি দারুণ মিল ওই ত্রিশে!

গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর একটি ভবন

দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে ৩টি দেশ এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত আর নেপাল। আর এদের অর্থনৈতিক শক্ত ভিত তৈরি হয় মূলত অবকাঠামো, কৃষি আর উৎপাদন খাতের অবদানে। এক্সপার্টদের ভাষ্য, ‘দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে রপ্তানি কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে।’ এ জন্য কী করতে হবে? বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হ্যান্স টিমার পরামর্শ দিচ্ছেন, “…Efforts should include trade liberalization, spurring entrepreneurship, and equipping citizens with the skills they need to compete on the global market. It would be good to be creative and relentless in all these efforts.”

অর্থাৎ ৩টি বিষয় মাথায় রেখেই এগুতে হবে দক্ষিণ এশিয় দেশগুলোকে- বাণিজ্যের উদারীকরণ, উদ্যোক্তাদের উৎসাহিতকরণ এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকতে দক্ষ জনবল তৈরি। ঠিক এ পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ। আর লাল-সবুজের প্রিয় দেশটাকে ধাপে ধাপে এগিয়ে দিচ্ছে ওয়ালটন।

লেখক: সাংবাদিক ও ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, ক্রিয়েটিভ অ্যান্ড পাবলিকেশন্স বিভাগ, ওয়ালটন গ্রুপ। ই-মেইল: mahfuzjnu21@yahoo.com