অর্থনীতি

ডলার সঙ্কটে রিজার্ভে টান, নানা পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশে ডলার সঙ্কট দেখা দেয়। ২০২২ সাল ডলার সঙ্কটের মধ্যেই কেটেছে। এতে রিজার্ভে টান পড়েছে। আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনা ও প্রবাসী আয় বাড়ানোসহ ডলারের সরবরাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তাতে ডলারের বাজারে অস্থিরতা কাটলেও সঙ্কট পুরোপুরি নিরসন হয়নি। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির গতি অব্যাহত থাকলে ডলার সঙ্কট আগামীতে নিরসন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০২২ সালের আগস্টে দেশে খোলা বাজারে ডলারের দাম বেড়ে রেকর্ড গড়েছিল। বাজার স্বাভাবিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বার বার দাম নির্ধারণের পাশাপাশি সময়ে সময়ে আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলার সরবরাহ করে। এই সরবরাহের কারণে রিজার্ভে টান পড়ে, কমতে থাকে রিজার্ভের পরিমাণ। নভেম্বর শেষে রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে। আগের মাসে রিজার্ভ ছিল ৩৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারি যখন শেষ হওয়ার দিকে, তখন বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছিল। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। তাতে অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ পড়ে। আমাদের আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়, বিপরীত দিকে প্রবাসী আয় কমে যায়। ফলে, ডলারের সঙ্কট শুরু হয়। একপর্যায়ে ডলারের বাজার অস্থির হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সঙ্কট নিরসনে নানা পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছে। তাতে ডলারের দামে লাগাম টানা সম্ভব হলেও সঙ্কট থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি। এখনো ডলারের সঙ্কটে ব্যবসায়ীরা। আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অপরদিকে, এই সঙ্কটের কারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্যের দাম কয়েক দফা বেড়েছে। বিপরীতে দিকে আলোচ্য সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহও কমে গেছে। এদিকে, আমদানি দায় পরিশোধ করতে রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করা হয়েছে। ততে রিজার্ভে টান পড়েছে। ধারাবাহিকভাবে কমেছে রিজার্ভ। যদিও কিছুদিন ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। কিন্তু, রিজার্ভ উল্টো গতিতে চলছে।

এ সম্পর্কে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মো. আইনুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেছেন, ডলার সরবরাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে গত মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ ধরে রাখতে পারলে ডলারের সঙ্কট অনেকটা কেটে যাবে। সেই সঙ্গে বিদেশি ঋণ আসার পর রিজার্ভ কিছুটা বাড়বে। বিশ্বের নতুন নতুন বাজারে পণ্য রপ্তানি বাড়াতে হবে। রপ্তানি বাড়ানোর জন্য সরকার নানা পদক্ষেপ নিলে ভবিষ্যতে রপ্তানির আয়ের মাধ্যমে ডলার সরবরাহ এবং রিজার্ভ আগের অবস্থানে ফিরে আসবে। 

ডলারের দাম পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২২ সালের শুরুতে ডলারের দাম ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আগস্ট মাসে খোলা বাজারে ডলারের দাম সর্বোচ্চ বাড়ে। খোলাবাজারে ১০ আগস্ট ডলারের দাম বেড়ে ১২০ টাকা অতিক্রম করে রেকর্ড গড়ে। তখনই নড়েচড়ে বসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

এদিকে, চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কেনাবেচা হয়েছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায়। তা ৯ জানুয়ারি বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ টাকায়। ২৩ মার্চ প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় বেচাকেনা হয়। গত ২৭ এপ্রিল ডলার প্রতি দাম ২৫ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সায় বেচাকেনা হয়েছে। মে মাসে আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারে ৪ বার বাড়ানো হয়েছে ডলারের দাম। তবু, বাজার স্থিতিশীল হয়নি। পরে ওই মাসের শেষ দিকে সঙ্কট নিরসনে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশের (এবিবি) দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৯ টাকা বেঁধে দেয়। আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির জন্য বিসি সেলিং রেট নির্ধারণ করা হয় ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা। যদিও ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৯ টাকা ৮০ পয়সা করার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু, তাতেও বাজার স্থিতিশীল না হওয়ায় ডলারের এক রেট উঠিয়ে দিয়ে গত ২ জুন আরও ৯০ পয়সা বাড়িয়ে ডলার দাম ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। পরে জুন মাসে আরও ৮ দফা বাড়িয়ে ৯৩.৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয় ডলারের দাম। জুলাই মাসেও কয়েক দফা বাড়িয়ে ডলারের দাম ৯৪.৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

এভাবে বার বার দাম বাড়িয়েও বাজার যখন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না, তখন ডলারের সঙ্কট নিরসন ও প্রবাসী আয় বাড়াতে দাম নির্ধারণের বিষয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) যৌথ সভায় ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয়। বাফেদার ঘোষিত দাম অনুযায়ী, দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে প্রতি ডলার সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা কিনতে পারবে ব্যাংক। বাণিজ্যিক রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বিল নগদায়ন হবে প্রতি ডলার ৯৯ টাকায়। এছাড়া, রেমিট্যান্স আহরণ ও রপ্তানি বিল নগদায়নে ব্যাংকগুলোর গড় (ওয়েট অ্যান্ড এভারেজ) মূল্যের সঙ্গে সর্বোচ্চ এক টাকা যোগ করে আমদানিকারকের কাছে ডলার বিক্রি করার সিদ্ধান্ত বলবৎ আছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ: ডলারের বাজারে অস্থিরতা ও সঙ্কট নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এ কারণে ডলারের বাজারে নৈরাজ্য অনেকটা কমেছে। ডলার কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকায় ৬ ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে অপসারণ, বেশকিছু মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স স্থগিত এবং কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়। নিয়মিত মনিটরিং জোরদার করা হয়। কেউ যাতে কৃত্রিমভাবে ডলার সঙ্কট সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও নজরদারি চলে। অনলাইনে লেনদেন হয় এমন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে ডলারের কারসাজি হচ্ছে কি না, তা ধরতে অভিযান চলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে ২৭ ব্যাংকের ৭১টি ক্রেডিট কার্ডে ডলার লেনদেনের সীমা লঙ্ঘনের মতো অনিয়ম পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলার কারসাজি রোধে রুটিনমাফিক ব্যাংক পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিম।

এদিকে, স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদনকারী অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য চলতি ঋণ সুবিধার দ্বার উন্মুক্ত করতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর্মরত টাইপ-এ (শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন) ও টাইপ-বি (দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানাধীন) শিল্প প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় উৎস থেকে টাকায় চলতি মূলধনী ঋণ গ্রহণের সুযোগ দেওয়াসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ডলার সরবরাহ বাড়াতে রেমিট্যান্স প্রেরণে নানা সুবিধা: বৈধ উপায়ে ওয়েজ আর্নার্স রেমিট্যান্সের বিপরীতে আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা, রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের সিআইপি সম্মাননা, রেমিট্যান্স বিতরণ প্রক্রিয়া সম্প্রসারণ ও সহজীকরণের পাশাপাশি অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিনিয়োগ ও গৃহায়ন অর্থায়ন সুবিধা দেওয়া, ফিনটেক পদ্ধতির আওতায় আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার অপারেটরকে বাংলাদেশের ব্যাংকের সঙ্গে ড্রয়িং ব্যবস্থা স্থাপনে উদ্বুদ্ধকরণ এবং রেমিট্যান্স প্রেরণে ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর চার্জ বা ফি মওকুফ করা হয়েছে।  এসব সুবিধার কারণে গত মাসে আগের চেয়ে রেমিট্যান্স বেশি এসেছে। তা আগামীতে অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে ডলার সরবরাহ আরও বাড়বে বলে আশা করছেন তারা।