ব্যাংক কর্মকর্তারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হলে তাদের বিরুদ্ধে মোটা অংকের অর্থ জরিমানা এবং ক্ষতির দায় নেওয়ার বিধান রেখে ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন’ ২০২৩-এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। ঋণ খেলাপিরা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন না। এমনকি তারা বিমানে উচ্চ শ্রেণিতে ভ্রমণ করতে পারবেন না।
সূত্র জানায়, মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে।
জানা গেছে, দুর্বল ব্যাংক-কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় নতুন অধ্যায় সংযুক্তি, স্বেচ্ছা ঋণ খেলাপিদের শনাক্ত করা এবং বিধিবিধান লঙ্ঘনে দণ্ডের মাত্রা বাড়িয়ে ১৯৯১ সালে প্রণীত ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
সংশোধিত আইন অনুযায়ী, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হলে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বড় অঙ্কের জরিমানার মুখে পড়তে হবে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা যাবে ফৌজদারি মামলা।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক ‘ঋণের আসল বা মূল ঋণ মওকুফ করতে পারবে না।’ প্রচলিত নীতিমালার আওতায় ব্যাংক ইচ্ছা করলে যে কোনো গ্রাহকের মূল ঋণ মওকুফ করতে পারে। এখন ঋণের জামানতের মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক যোগ্য বলে বিবেচিত হতে হবে।
অন্যদের মধ্যে বিধি বহির্ভূতভাবে ‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহার করা হলে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা কিংবা সাত বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। বিধি লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে প্রতিদিন এক লাখ টাকা হারে জরিমানা দিতে হবে।
সূত্র জানায়, এর আগে ২০২১ সালের ১৭ মে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সভায় ব্যাংক-কোম্পানি আইন সংশোধনের একটি খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। পরে জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের পর আইনটির কিছু বিষয় আরো সংশোধনের জন্য ফেরত পাঠানো হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধিত আইনটি দ্বিতীয় দফা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উঠছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে কর্মরত ব্যাংক কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১’-এর আওতায় পরিচালিত হয়। ব্যাংকগুলোর মোট সংখ্যা, মোট সম্পদ, আমানত, ঋণ, লিজ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বিদ্যমান আইনে সবকিছু কভার করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় দেশের ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনা, তদারকি, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, দেশের আর্থিক খাতের সুশাসন ও স্থিতিশীলতার জন্য বিদ্যমান আইনটিতে সংশোধনী আনা হয়েছে।
সূত্র জানায়, এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো জিনিস রয়েছে, তা হলো ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতার সংজ্ঞা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই বিষয়টি আগের আইনে তেমন স্পষ্ট ছিল না। এছাড়া সংশোধিত আইনে ‘দুর্বল ব্যাংক কোম্পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার’ সংক্রান্ত নতুন একটি ধারা সংযোজন করা হয়েছে। এতে ব্যাংক কোম্পানির সঙ্কটাপন্ন অবস্থার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি রয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি পুনর্গঠন ও একত্রীকরণের বিধানও নতুন আইনে আছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এ খাতের ওপর জনগণের আস্থা বাড়াতে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের চূড়ান্ত খসড়ায় এসব বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
সংশোধিত আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক নির্ধারিত পরিমাণ ও হারে এর তারল্য, সম্পদের গুণগত মান, মূলধন সংরক্ষণ ও আয় অর্জনে ক্রমাগতভাবে, যা দুই বছরের বেশি নয়, ব্যর্থ হলে এবং এ পরিস্থিতির কারণে ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে পড়লে এবং অচিরেই ব্যাংকটি আরো সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় উপনীত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকটিকে ‘দুর্বল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। চিহ্নিত কোনো ‘দুর্বল’ ব্যাংক নতুন আমানত গ্রহণ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারবে না। দুর্বল ব্যাংকের পুনর্গঠন বা একত্রীকরণ এবং অধিগ্রহণ কিংবা অবসায়ন কিংবা অন্য কোনো উপযুক্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি কমিটি গঠন করবে।
খসড়া অনুযায়ী, চিহ্নিত দুর্বল ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃক প্রণীত একটি কর্ম-পরিকল্পনার আওতায় পুনর্গঠনের জন্য ব্যাংকটিকে এক বছর সময় বেঁধে দিতে পারে। পুনর্গঠনের সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের লিখিত পূর্বানুমোদন ছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যাংক নতুন কোনো ব্যাংক-ব্যবসায় নিয়োজিত হতে বা সম্প্রসারণ করতে পারবে না; বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত বার্ষিক ভিত্তিতে তার ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ঋণ বা অগ্রিম) বৃদ্ধি করতে পারবে না এবং নগদ মুনাফা বণ্টন করতে পারবে না।
সংশোধিত খসড়া অনুযায়ী, ব্যাংকটির নিজস্ব পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক গঠিত কমিটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে এক বা একাধিক ব্যবস্থা নিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে-সংশ্লিষ্ট ব্যাংক-কোম্পানির ব্যবসা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা; ব্যাংক-কোম্পানির পুনর্গঠন; অন্য কোনো ব্যাংক-কোম্পানির সাথে একত্রীকরণ; ব্যাংক কোম্পানি পুনর্গঠনে অন্য যেকোনো পদক্ষেপ বা কার্যক্রম গ্রহণ; লাইসেন্স বাতিল ও অবসায়ন। একই সঙ্গে ব্যাংক-কোম্পানির সঙ্কটাপন্ন অবস্থার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে। এর আওতায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনধিক ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। ক্ষতিকর কার্যকলাপের জন্য ব্যাংকের চেয়ারম্যান/ব্যবস্থাপনা পরিচালক অপসারিত হলে তিনি আর্থিক ক্ষতি পূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন।
সংশোধিত আইনে স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিদের তালিকা করতে প্রতিটি ব্যাংকে দুটি কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি কমিটি স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিদের শনাক্ত করবে এবং অপর একটি তালিকা চূড়ান্ত করবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের সামাজিকভাবে বর্জন করার জন্য রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য খসড়ায় বলা হয়েছে। এর মধ্যে গাড়ির নিবন্ধন নেওয়া, বিমানে উচ্চ শ্রেণিতে ভ্রমণ এসব বাধা সৃষ্টি করতে বলা হয়েছে।