২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৪৬.৯৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০.২৭ শতাংশ বেশি। তবে, আগের তুলনায় রপ্তানি বাড়লেও বর্তমান বাস্তবতায় পোশাক শিল্পে নতুন করে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে।
চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া ও চীন ভিত্তিক ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বর্তমান দুর্বল বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং আরেকটি ভবিষ্যত মন্দা সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ। এর পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে এই খাতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন করে তুলেছে।
‘উন্নয়নের বিষয়সমূহ: পোশাক শিল্পে সামগ্রিক গবেষণা ও নারী শ্রমিকদের ভবিষ্যত’ শীর্ষক সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের সাথে যৌথভাবে এই সমীক্ষাটি করে বিজনেস কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসল পার্টনার্স। সমীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল—স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যে অগ্রযাত্রা, তা এগিয়ে নিতে পোশাক খাতে কী বাধা ও কী করণীয় আছে, তা চিহ্নিত করা।
শনিবার (৪ নভেম্বর) রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে এক গোলটেবিল বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ঢাকা, সাভার, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের ৪২টির বেশি পোশাক শিল্প মালিক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা; ভারত, কেনিয়া, ব্রাজিল, সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশের পোশাক ক্রেতা এবং ৫০ জন নারী কর্মীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে সমীক্ষা করা হয়।
সমীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের হ্রাসকৃত পোশাক চাহিদা এই শিল্পে সঙ্কট আরও ঘনীভূত করবে। এর ফলে অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাতে নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যেতে পারে।
এই খাতের নীতিনির্ধারক ও শিল্পপতিদের লক্ষ্য করে ’বাংলাদেশে পোশাক খাতে ভবিষ্যত করণীয়’ শিরোনামে দুটি ’সংক্ষিপ্ত নীতি’ তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বর্তমানে এইচঅ্যান্ডএম ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ও এশিয়া ফাউন্ডেশনের পরিচালনায় ‘অপরাজিতা: বাংলাদেশে এই সংক্রান্ত ভবিষ্যত কাজে যৌথ প্রভাব’ শিরোনামে দুই বছরব্যাপী একটি প্রকল্প চালু রয়েছে। যাতে প্রকল্পের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, পোশাক শিল্পে আধুনিক মেশিন স্থাপনের প্রভাব বা পোশাক খাতকে অটোমেশনের ফলে নারী পোশাককর্মীদের ভবিষ্যত জীবিকা সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। দেশের মোট রপ্তানির ৮৪. ৫ শতাংশই এ খাত থেকে হয়। দেশে ৪ হাজারের বেশি কারখানায় প্রায় ৪০ লাখ লোক জড়িত, যাদের অধিকাংশই নারী। তাই, শিল্পের উন্নয়নে ও শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা বাড়াতে ন্যায়সঙ্গত মজুরির পাশাপাশি সুন্দর কর্মপরিবেশ ও শারীরিক সুস্থতার ওপর জোর দেওয়া উচিত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, করোনা মহামারী পোশাক খাতকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। এর ফলে অনেক আন্তর্জাতিক আদেশ (অর্ডার) বাতিল হয়েছে। এতে আনুমানিক ৩.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে। ২০২২ সালে এর প্রভাব কাটানোর জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছিল, তা বিভিন্ন কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে এ খাতের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ধাক্কাগুলো সামাল দিতে হবে। এর পাশাপাশি এই শিল্পে গতিশীলতা ও দক্ষতা আনয়নে অটোমেশনের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও শ্রমিকদের কাজের সংস্থানের প্রভাবও বিবেচনায় আনা জরুরি।
এছাড়া সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেশে পরিবেশ সুরক্ষায় টেক্সটাইল বর্জ্যের পুনর্ব্যবহারযোগ্য পদ্ধতির দিকে মনোনিবেশ করা, শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত মজুরি, বয়স্ক কর্মীদের অন্য পেশায় স্থানান্তর এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির স্বার্থে এই খাতের আর্থিক নীতিগুলো সহজী ও বাস্তবসম্মত করার সুপারিশ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই খাতে বড় ধরণের ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।
গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আবদুস সামাদ আল আজাদ ও বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. এম. মাসরুর রিয়াজ। লাইটক্যাসল পার্টনার্স থেকে বক্তব্য রাখেন প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক জাহেদুল আমিন, সামিহা আনোয়ার, পোর্টফোলিও ম্যানেজার রাদি শফিক ও অন্যান্য কর্মকর্তারা।
প্রসঙ্গত, গত ছয় বছরে লাইটক্যাসল এ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে। এতে বাংলাদেশে পোশাক খাতের চ্যালেঞ্জ ও তা মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়।