ইলেকট্রনিক মুদ্রায় লেনদেনে গ্রাহকদের ঝুঁকি কমানো ও সুরক্ষায় শাস্তির বিধান রেখে নতুন আইন হচ্ছে। এই আইনের আওতায় বিকাশ, নগদ, উপায়, ই-ওয়ালেট প্রভৃতি ইলেকট্রনিক মুদ্রায় লেনদেনে গ্রাহক স্বার্থ সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে অনুমোদনের জন্য এ সংক্রান্ত একটি বিল সংসদে উত্থাপন করা হবে।
এই আইনের নামকরণ করা হয়েছে, ‘ইলেকট্রনিক মুদ্রায় সেবা প্রদানে পরিশোধ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা বিল ২০২৪।’ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এই আইনটি প্রণয়ন করেছে।
আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন বা লাইসেন্স গ্রহণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক-কোম্পানি কোনো পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ, পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনা বা ইলেকট্রনিক মুদ্রায় পরিশোধ সেবা দিতে পারবে না। পরিশোধ সেবা দেওয়ার নিয়মাবলি হতে হবে নৈর্ব্যক্তিক, বৈষম্যহীন ও সঙ্গতিপূর্ণ; গ্রাহকের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কোনো বিধান অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
এতে বলা হয়েছে, বিধিবিধান লঙ্ঘন করে কোনো প্রতিষ্ঠান লেনদেন ব্যবসা পরিচালনা করলে বা মিথ্যা তথ্য বা বিবৃতি দিলে প্রস্তাবিত আইনে অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৩০ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
লাইসেন্স বাতিল হওয়ার পর কোনো প্রতিষ্ঠান এ ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করলে সেক্ষেত্রে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অনধিক ৫০ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় বাধা দিলে এক লাখ টাকা থেকে অনধিক পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে।
বলা হয়েছে, অনুমোদন বা লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য নির্ধারিত ফরম পূরণ, পদ্ধতি অনুসরণ ও ফি প্রদান সাপেক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করতে হবে। আইন কার্যকর হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে লাইসেন্স গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান তাদের যাবতীয় কার্যক্রম আইনের বিধানাবলির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করবে এবং ইতোমধ্যেই পরিশোধ সেবা পরিচালনাকারী ব্যাংক-কোম্পানিগুলোকে আইন কার্যকর হওয়ার এক বছরের মধ্যে লাইসেন্স নিতে হবে।
এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেছেন, বর্তমানে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনেক ধরনের লেনদেন হচ্ছে। মূল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে ইন্টারনেট ও এজেন্ট ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক তহবিল স্থানান্তর, ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডসহ বিকাশ, নগদ, রকেট, বিভিন্ন ব্যাংকের ই-ওয়ালেট, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক মুদ্রা, ইলেট্রনিকভাবে তহবিল স্থানান্তর, চেক ইলেট্রনিকভাবে উপস্থাপন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা, ট্যাংকেটেড চেক, ট্রাস্ট কাম সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্ট, সরকারি সিকিউরিটিজ সেটেলমেন্ট সিস্টেম ইত্যাদি। এসব পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ, অর্থ গ্রহণ ও গ্রাহকের অর্থ চাহিদা নিস্পত্তি হচ্ছে। আর এসব পদ্ধতি ব্যবহার করছে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউট। এদের কার্যক্রম তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো এবং গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এ আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে।
এই আইনের আওতায়, মূল ব্যাংকিং সেবার বাইরে অর্থ লেনদেন পরিশোধ ব্যবসায় আগ্রহী ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ সেবা দেওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ সংক্রান্ত পৃথক অনুমোদন নিতে হবে। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মূলধন, মালিকানা ও পরিচালনার বিষয়ে ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১’-এর ১৪ নম্বর আইনের সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান অনুসরণ করতে হবে।
এছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান-বহির্ভূত অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি অর্থ লেনদেন পরিশোধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে আগ্রহী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান অনুসরণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিতে হবে এবং ব্যবসা পরিচালনাকারীকে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নিয়মে সময়ে সময়ে নির্ধারিত পরিমাণে, হারে ও পন্থায় মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে।
বিলে বলা হয়েছে, পরিশোধ সেবা প্রদানকারী পরিশোধ সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে গ্রাহকের হিসাব খোলা, ইলেকট্রনিক মুদ্রা ইস্যু করা ও ইলেকট্রনিক মুদ্রায় লেনদেন সম্পাদন এবং ট্রাস্ট ও সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্টের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনাকারী পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে লেনদেন নিস্পত্তি সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনাসহ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত অন্য কোনো পদ্ধতিতে গ্রাহকদের পরিশোধ কার্যক্রমে সহায়তা করতে পারবে।
পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী নিজের বা গ্রাহকের পক্ষে পরিশোধ, নিকাশ ও নিস্পত্তি ব্যবস্থায় অংশগ্রহণসহ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নিস্পত্তি ব্যবস্থা পরিচালনা সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনাকারী, পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী ও পরিশোধ সেবাদানকারী নিস্পত্তি সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সেবাগ্রহীতার অর্থ ধারণ করলে, ওই অর্থের ব্যবস্থাপনা ট্রাস্ট ও সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সম্পন্ন করবে।
অন্যদিকে, সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা-নিষেধের মধ্যে রয়েছে এ আইনের অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি ‘অগ্রিম পরিশোধিত দলিল’ ইস্যু বা ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না এবং জনগণ থেকে কোনো প্রকার বিনিয়োগ গ্রহণ, ঋণ প্রদান, অর্থ সংরক্ষণ বা আর্থিক লেনদেন উদ্ভব হয় এমন কোনো অনলাইন বা অফলাইন প্ল্যাটফর্ম পরিচালনা করতে পারবে না।
বিলে বলা হয়েছে, পরিশোধ ব্যবস্থা সেবা প্রদানে লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মাবলি অনুসরণ-করে নিজস্ব নিয়মাবলি প্রণয়ন ও প্রকাশ করবে। নিয়মাবলিতে তারল্য, নিষ্পত্তি, কারিগরি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, সুশাসন, নিরবচ্ছিন্ন পরিচালন, আপৎকালীন ব্যবস্থা, বিরোধ নিস্পত্তি, গ্রাহকসেবা ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ ক্ষেত্রে শর্ত থাকে যে, নিয়মাবলি নৈর্ব্যক্তিক, বৈষম্যহীন ও সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে এবং গ্রাহকের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কোনো বিধান অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। পরিশোধ সেবা পরিচালনাকারী বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নীতিমালার আওতায় কোনো তৃতীয় পক্ষ থেকে আউটসোর্সিং সেবা নিতে পারবে বা এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে গ্রাহককে সংশ্লিষ্ট পরিশোধ সেবা দিতে পারবে।