দুর্বল ব্যাংক হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ব বেসিক ব্যাংককে বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সংবাদে সরকারি সংস্থাগুলো আমানত তুলে নিচ্ছে। এতে ব্যাংকটি তারল্য সংকটে পড়েছে। ফলে যেকোনো সময় ডিজঅনার হতে পারে চেক। এতে একীভূত হওয়ার আগেই প্রতিষ্ঠানটি আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও আমানত সরবরাহের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে চিঠি দিয়েছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, বেসিক ব্যাংক ১৯৯২ সাল থেকে সরকারের ভালো একটি ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু, ২০১৪-২০১৫ সময়ে অনিয়মিতভাবে ঋণ বিতরণ করার ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণ শ্রেণিকৃত হওয়ার কারণে ব্যাংকটি আস্থা সংকটে পড়ে। এ কারণে ব্যক্তি পর্যায়ে আমানত সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক হিসেবে ব্যাংকের মোট আমনতের প্রায় ৮০ শতাংশ আমানত সরকারি উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত সংস্থা, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ করপোরেশন, শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড, যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড, তিতিস গ্যাস ট্রান্সফিউশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডসহ আরও অনেক সরকারি সংস্থা বেসিক ব্যাংকে নিয়মিত আমানত রাখে। সরকারি সংস্থার অধিকাংশ আমানতগুলো উচ্চ সুদবাহী।
শ্রেণিকৃত ঋণের আধিক্য ও উচ্চ সুদের আমানতের কারণে ব্যাংকের মূল ব্যবসায়িক সূচকগুলো ভালো থাকা সত্ত্বেও লোকসান হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন ঘাটতি হচ্ছে। যার বিরূপ প্রভাব ক্যামেলস রেটিংয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহায়তা দেওয়ার ফলে প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন ঘাটতি পূরণে সময় পাওয়া গেছে। এছাড়া ক্যামেলস রেটিং ও ঋণ-আমানত অনুপাতের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং এ ব্যাংকের বিল বন্ড এর বিপরীতে রেপো করার মাধ্যমে অর্থ সরবরাহে সহায়তা করছে। বৃহৎ অংকের শ্রেণিকৃত ঋণ এবং উচ্চ সুদের আমানতের কারণে লোকসান করা সত্ত্বেও বেসিক ব্যাংক ইতোপূর্বে কখনোই বিধিবদ্ধ তারল্য রিজার্ভ (সিআরআর ও এসএলআর) এর ঘাটতির সম্মুখীন হয়নি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কখনোই অর্থ ধার করার প্রয়োজন হয়নি।
চিঠিতে বলা হয়েছে,বর্তমান পর্ষদের নেতৃত্বে সুশাসন নিশ্চিত হওয়ায় বিভিন্ন ব্যবসায়িক সূচকে ব্যাংকটি ভালো অবস্থায় ধাবিত হচ্ছিল। ব্যাংকের আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি মাসে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এর কিস্তি বাবদ প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়। গত বছর কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের জন্য ২১ মিলিয়ন ডলারের এলসি পরিশোধ করা হয়। এছাড়া সরকারি খাতের বাংলাদেশ কেমিকাল ইন্ডাষ্ট্রিজ করপোরেশন, ন্যাশনাল টিউবস লিমিটেড, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড ইত্যাদি সংস্থার আমদানি এলসি খোলা হয় যার অধিকাংশ ডলার এ ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে সরবরাহ করা হয়।
গত তিন বছরে শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে ৫৬৩ কোটি টাকা নগদ আদায় হয়েছে। গত তিন বছরে বিতরণকৃত কোন ঋণ শ্রেণিকৃত হয়নি। মোট ৭২টি শাখার মধ্যে লোকসানী শাখার সংখ্যা ৩২টি থেকে ১৭টিতে কমানো হয়েছে। খরচ কমিয়ে আনার ফলে পরিচালন ব্যয় কমেছে। ঋণ আমানতের অনুপাত ১১৫ শতাংশ থেকে কমে ৮৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু, গত ৮ এপ্রিল গণমাধ্যমে একটি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকটি একীভূতকরণের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে অস্বাভাবিকভাবে আমানত উত্তোলনের ফলে ব্যাংকটি গভীর সংকটে পড়েছে। বিভিন্ন আমানতকারীরা ইতোমধ্যে প্রায় ২৫০০ কোটি টকা উত্তোলন করেছে। উপরন্তু সরকারি বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক আরও আমানত উত্তোলনের জন্য ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য কোনো উৎস থেকে নতুন আরও আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে অস্বাভাবিকভাবে প্রতিনিয়ত আমানত উত্তোলন করা হচ্ছে।
বর্তমানে বেসিক ব্যাংকের পক্ষে বন্ড রেখে/রেপো করে সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেওয়ার সুযোগ নেই বা শেষ হয়ে গেছে। আন্তঃব্যাংক কল মার্কেটেও টাকা ধার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে, সৃষ্ট আতঙ্কে বেসিক ব্যাংকে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার কারণে গ্রাহকদের মধ্যে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে তাতে ব্যাংকের বিধিবদ্ধ তারল্য রিজার্ভ (এসএলআর) এর ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮০০ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে এ ব্যাংকে কখনো তারল্য রিজার্ভ (এসএলআর) এর ঘাটতি হয়নি বা চেকও ফেরতের ঘটনা ঘটেনি। বর্তমান পরিস্থিতির আশু উন্নতি না ঘটলে যেকোনো মুহূর্তে চেক ফেরতের আশঙ্কা রয়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংকটি অচিরেই গভীর সংকটে পড়বে যার নেতিবাচক প্রভাব সমগ্র ব্যাংকিং খাতের ওপর পড়ার আশংকা তৈরি হবে। এছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না গেলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়াও অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়বে বলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনে করছেন।
এ অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পক্ষ থেকে। সেগুলো হচ্ছে- বেসিক ব্যাংক একটি সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক এবং এ ব্যাংকে আমানত রাখা ঝুঁকিমুক্ত এবং নিরাপদ-এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে বলা। আমানত প্রদানকারী সরকারি সংস্থাসমূহকে আমানত সংরক্ষণের নির্দেশনা দেওয়া। স্বল্পসুদে সরকার থেকে আমানত সরবরাহসহ নীতি সহায়তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। একীভূতকরণ সংশ্লিষ্ট সংবাদটির বিষয়ে মালিকপক্ষ হিসেবে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আনিসুর রহমান বলেন, বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ এবং ব্যাংকের অবসায়ন নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় গ্রাহকেরা টাকট তুলে নিচ্ছেন। এ অবস্থায় এই সৃষ্ট সংকট ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় বেসিক ব্যাংকের পক্ষে এককভাবে এ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন।