বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘ সময় ধরে মন্দা ভাব চলছে। ফলে, সুদিনের পরিবর্তে খারাপ সময়ই বেশি পার করতে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। দেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আনস্টেবল পলিসি মেকিংয়ের কারণেই পুঁজিবাজার এতটা আনস্টেবল হয়ে পড়েছে।
পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বাধাগুলো কী কী এবং এর থেকে উত্তরণের পথ কী, তা নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে আলোচনাকালে ডিসিশন মেকার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও স্মার্ট শেয়ার অ্যান্ড সিকিউরিটিজ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক এম তালুকদার এসব কথা বলেন। তার সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তুগুলো পাঠকদের উদ্দেশে তুরে ধরা হলো।
রাইজিংবিডি: পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে আপনি কী মনে করেন? এম তালুকদার: দেখুন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘ সময় ধরে মন্দা ভাব চলছে। মার্কেটের আজকের এমন অবস্থার পেছনে অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম যে সমস্যাটি আমার মনে হয়, তা হলো—ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন করা। এর পর রয়েছে পূর্বের সমস্যাগুলোর সমাধান না করেই জোড়াতালি দিয়ে বাজারকে ম্যানুপুলেট করার চেষ্টা। মার্কেটের ওঠানামা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু, আমাদের দেশে ২০২০ সালে মার্কেট যখন কারেকশন হয়ে, তখন সূচক প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পয়েন্টে নেমে এসেছিল। তখন তাকে কারেকশন কমপ্লিট করতে দেওয়া হয়নি। উল্টো বিনিয়োগকারীদের কথা চিন্তা করে ফ্লোর নামক আর্টিফিশিয়াল একটা জিনিসের পরিচয় করানো হয়েছিল, যা এখন পর্যন্ত মার্কেট বিদ্যমান রয়েছে। তো এসব আর্টিফিশিয়াল ইস্যু থেকে মার্কেটকে বের করে নিয়ে আসতে না পারলে মার্কেট লং রানে (দীর্ঘ মেয়াদে) কখনোই ভালো হবে না। ফ্লোর কি আসলেই ভালো কিছু দিতে পেরেছে মার্কেটকে? মোটেও না। কারণ, ২০২০ সালে যে ফ্লোর দেওয়া হয়েছিল, তখনকার প্রাইস থেকে বর্তমানে প্রায় ১২১টা শেয়ার ওই ফ্লোর প্রাইসের নিচে আছে। অথচ মধ্যে থেকে চার বছর চলে গেছে।
রাইজিংবিডি: পুঁজিবাজারে ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন করা হয়ে থাকে বিনিয়োগকারীদের কথা চিন্তা করে। আপনি কি মনে করেন, নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে মার্কেটের উন্নয়ন সম্ভব? এম তালুকদার: আমদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো খুব কম সময়ের ব্যবধানে পলিসি পরিবর্তন করে ফেলে। ফলে, বিনিয়োগকারীদের মনে সংশয় তৈরি হয়। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে থাকেন। যেমন: আপনি এমন একটা জায়গায় টাকা ইনভেস্ট করবেন, যেখানে জানেনই না, ওই জায়গার নিয়মকানুন কেমন সাসটেইন করবে। আনস্টেবল পলিসির মধ্যে আপনি বড় ধরনের ইনভেস্টমেন্ট করবেন বা কেউ কি এটা করবে? করবে না। দুই-এক দিন পর পর ফ্লোর দেওয়া হয়, আবার তা তুলে নেওয়া হয়। আবার শেয়ার দরের সর্বনিম্ন সীমা ২ শতাংশ করা, ১০ শতাংশ করা এবং আবার ৩ শতাংশ করা—এগুলো একের পর এক চলছেই। আমার মতে, আনস্টেবল পলিসি মেকিংয়ের জন্যই বর্তমান পুঁজিবাজার এতটা আনস্টেবল।
রাইজিংবিডি: পাশের দেশ ভারতে সূচক বর্তমানে ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের মন্দা ভাব কাটছে না। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সাথে অন্যান্য দেশের পুঁজিবাজারের কী পার্থক্য আছে বলে আপনি মনে করেন? এম তালুকদার: সারা দুনিয়ায় যতগুলো স্টক মার্কেট আছে, এর মধ্যে বিরল হচ্ছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। যে বাজারের পলিসি আপনাকে প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহ এবং প্রতি মাসে পড়ে মুখস্থ করে রাখতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেটের কয়টা নিয়ম আছে, তা কি কেউ বলতে পারবে? যেমন: ১০ থেকে ১২টা শেয়ার আছে এখনো ফ্লোরে। যাদের মালিকানায় রয়েছে অনেক বড় বড় ফেইস। অনেকের নামও উচ্চারণ করা যাবে না, এমন লোকদের কোম্পানির শেয়ার এখনো ফ্লোরে। আবার অন্য শেয়ারগুলা ৩ শতাংশের নিচে কমতে পারছে না, কিন্তু বাড়তে পারছে ১০ শতাংশ। ব্লক মার্কেটেও ৩ শতাংশের নিচে ট্রেড করা যাচ্ছে না। এমন উদ্ভট পলিসি দুনিয়ার মধ্যে আর একটা মার্কেট দেখাতে পাবেন না। বর্তমান সময়ে বৈশ্বিক পুঁজিবাজারের সঙ্গে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় পার্থক্য এগুলোই।
রাইজিংবিডি: পুঁজিবাজারে যেসব জায়গায় ঘাটতি রয়েছে, সেগুলো পূরণ করলেই কি বাজার ভালো হবে? এম তালুকদার: সত্যি কথা বলতে, বাজারে সবচেয়ে বড় যে জিনিসটার অভাব, তা হলো জবাবদিহিতা। এখানে যাদের হাতে ক্ষমতা আছে, তারা তাদের মতো করে সুবিধা নিচ্ছে। উল্লিখিত বিষয়গুলোই কেবল পুঁজিবাজারের আজকের এই অবস্থার জন্য দায়ী নয়, অনেকগুলা কারণের মধ্যে তা কয়েকটা মাত্র। আর যদি কিছু কারণ বলতে হয়, তাহলে রয়েছে—ক্রয়মূল্য ও বাজারমূল্য নিয়ে কিছুদিন আগে যে পলিসি পরিবর্তন করা হয়েছে, সেটাও বিশাল ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। আজকের মার্কেটের এই অবস্থার পিছনে এইটাও একটা উল্লেখ করার মতো বড় কারণ। এটার কারণে ব্যাংকের ক্র ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। আমরা ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটের বাইরে এসে লোকাল মার্কেটের পলিসি করছি। তারপর আইন সবার জন্য সমানভাবে কাজ করছে না। যেমন: ইদানিং হুটহাট কিছু কোম্পানি জেড ক্যাটেগরিতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার একই অপরাধে অপরাধী হওয়া সত্ত্বেও অনেক কোম্পানিকে জেড ক্যাটেগরিতে পাঠানো হচ্ছে না। তাহলে বোঝা যায়, আইনটা সবার জন্য সমানভাবে কাজ করছে না। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম তো ভালো ও বিচক্ষণ মানুষ। কিন্তু, আমার ধারণা, উনাকে যারা যুক্তি-পরামর্শ দিয়ে কাজগুলা করাচ্ছেন, তাদের মধ্যে সমস্যা আছে। তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উনাকে খারাপ অবস্থায় ফেলছেন।
রাইজিংবিডি: পুঁজিবাজারে ভালো বিনিয়োগকারী আনার ব্যাপারে বড় প্রতিবন্ধকতা কী এবং তা সমাধানের উপায় কী? এম তালুকদার: এখানে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাই হচ্ছে বার বার নীতিগত পরিবর্তন ও ইন্টারনাল ইলিগ্যাল ইনভল্ভমেন্ট। এখানে ভালো বিনিয়োগকারী আনতে হলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে দিতে হবে। ভালো মাঠ না দিতে পারলে তো ভালো খেলোয়াড় আসবে না। যেমন: বাংলাদেশের ফুটবল মাঠগুলো তেমন মানসম্মত না হওয়া ও খেলোয়াড়দের ভালো অর্থ দিতে না পারার কারণে কিন্তু বাংলাদেশে ভালো খেলোয়াড় আসে না। তেমনই পুঁজিবাজারেও বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না, কারণ তাদের আমরা ভালো পরিবশে দিতে পারছি না। ডিএসইতে কারিগরি ত্রুটি বা সমস্যা দেখা দেয় দুই দিন পর পর। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যদি এসব দেখে, তাহলে তারা কেন আসবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে? ভালো বিনিয়োগকারী আনতে চাইলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দিতে হবে। রাতারাতি পলিসি পরিবর্তন করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি সম্ভব হবে না কখনো। মাঝেমাঝেই পত্রিকা মারফত জানা যায়, আজ বিএসইসি ওই প্রতিষ্ঠানকে ফোন দিয়ে সেল করতে মানা করেছে। ওই বড় বিনিয়োগকারী সেল দিচ্ছিল, তাকে আটকে দিয়েছে। আসলে এই ধরনের ঘটনায় খুচরা বিনিয়োগকারীরা খুব খুশি হয়। কিন্তু, তার ভয়াবহ প্রভাব সম্পর্কে কারো ধারণাই নেই। এতে এক দিনের জন্য সুচক বাড়লেও পরদিন আবার কমতে থাকে। ধরুন, আপনি ১০০ কোটি বিনিয়োগ করেছেন বাজারে। আপনার মনে হচ্ছে, বাজার পড়বে, কিন্তু এটা বুঝতে পেরেও আপনি চাইলেই শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। বিক্রি করতে গেলেই বাধা আসছে। ফলাফল, খুচরা বিনিয়োগকারীদের বাঁচাতে গিয়ে বড় বিনিয়োগকারীদের কাঁধে লোকসানের বোঝা বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই আতঙ্কে বাজারে বড় বিনিয়োগকারী আসে না। বাজার বাড়ল না কমল, সেটা দেখার দায়িত্ব প্রাইভেট ইনস্টিটিউট অথবা বড় বিনিয়োগকারীদের নয়। তারা আসছে ব্যাবসা করতে। বাজারের ইন্ডেক্স বাড়াতে আসেনি। তাদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। ক্রয়-বিক্রয়ে কোনো ধরনের বাধা দেওয়া যাবে না। কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না। ইনসাইডার ট্রেডিং করলে শক্ত হাতে ধরতে হবে। কিন্তু, নিয়মমাফিক শেয়ার বিক্রি করতে চাইলে বাধা আসবে, সেটা কোনোভাবেই একজন বড় বিনিয়োগকারী মেনে নেয় না। এই ধরনের ঘটনা দেশের পুঁজিবাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। এতে বাজার থেকে অনেক বড় বিনিয়োগকারীরা সরে গেছে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেকে আসছে না এই ভেবে যে, যদি স্বাধীন ভাবে ব্যাবসা করা না যায়।
রাইজিংবিডি: পুঁজিবাজারে ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স রেখেই এবারের জাতীয় বাজেট পাস করা হয়েছে। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন? এম তালুকদার: পুঁজিবাজারে ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স রেখেই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট রোববার (৩০ জুন) পাস হয়েছে। বাজেটে ৫০ লাখ টাকার বেশি মূলধন আয়ের ওপর স্তরভিত্তিক করারোপ করা হয়েছে। আমি এ বিষয়টিকে সাধুবাদ জানাই। এটি পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছি।
রাইজিংবিডি: পুঁজিবাজারের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে এই মুহূর্তে করণীয় কী? এম তালুকদার: সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে ব্যবসা করতে পারছেন না। মানুষের মধ্যে আস্থার জায়গাকে আগে ঠিক করতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এই মুহূর্তে আরো সাহসী হতে হবে। সকল ধরনের জঞ্জাল দূর করতে হবে। যেমন: এক দিনে শেয়ারের মূল্যসীমা ৩ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না, এ সিদ্ধান্ত উঠিয়ে দিতে হবে। মার্কেটকে তার নিজের গতিতে চলতে দিতে হবে। এছাড়া, যেসব কোম্পানি ফ্লোরে রয়েছে, তা উঠিয়ে দিতে হবে। ন্যাচারালি মার্কেট কমবে এবং বাড়বে। যখনই অযাচিত হস্তক্ষেপ করা হবে, তখনই তার স্বাভাবিক গতিশীলতা ব্যাহত হবে। তাই একটু শক্ত হতে হবে, পৃথিবীর কোনো মার্কেট কারেকশন হতে হতে শূন্যে পয়েন্টে নেমে আসে না। একটা পর্যায়ে তা আবার বাড়তে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবে বাড়লেই সেটা একটি দীর্ঘ সময়ের জন্য ভালো ফল দেয়। তাই, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এক দিনে শেয়ারের মূল্যসীমা ৩ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না বলে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা দ্রুত সমাধান করা জরুরি বলে মনে করছি।