অর্থনীতি

ডিএসই’র স্বতন্ত্র পরিচালক পদে বিতর্কিতদের চান না স্টেকহোল্ডাররা

দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) স্বতন্ত্র পরিচালকদের নিয়োগ নিয়ে বিতর্কিত যেন থামছেই না। ইতোমধ্যে বিতর্কের জেরে নিয়োগ পাওয়া মালদ্বীপ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান কে এ এম মাজেদুর রহমান ও সেন্টার অন ইনটিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিকের (সিরডাপ) রিসার্চ ডাইরেক্টর ড. মো. হেলাল উদ্দিন ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।

তবে, বিতর্কিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. নাহিদ হোসেন ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালকের পদ থেকে এখনো অব্যাহতি নেননি। ফলে এ বিষয়টিকে নিয়ে পুঁজিবাজারের স্টেকহোল্ডাররা সন্তুষ্ট নন। তাই সময়ক্ষেপণ না করে বিতর্কিত ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে আইন মেনে দ্রুত স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার দাবি পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের।

এদিকে, ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে গত ৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে নির্দেশনা চেয়ে চিঠি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। চিঠিতে বিএসইসি কে এ এম মাজেদুর রহমানের নিয়োগ নিয়ে জটিলতার কথা উল্লেখ করলেও ড. মো. হেলাল উদ্দিন ও ড. নাহিদ হোসেনের বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করেনি। তবে, ওই তিন ব্যক্তির নিয়োগে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের সমালোচনা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে কে এ এম মাজেদুর রহমান ও ড. মো. হেলাল উদ্দিন সরে দাঁড়িয়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে ডিএসই স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসিকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) নেতৃবৃন্দরা। একইসঙ্গে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইন যথাযথভাবে পরিপালন করে ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।

এদিকে, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. নাহিদ হোসেনের উচিত পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। কারণ তার নিয়োগ নিয়ে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অসন্তোষ ও মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া, ডিএসই রেগুলেশন, ২০১৩ এর ৫ ধারার (জে) উপধারায় অনুযায়ী স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত সচিব ড. নাহিদ হোসেনের নিয়োগ বৈধ নয়।

ডিএসই রেগুলেশন, ২০১৩ এর ৫ ধারার (জে) উপধারায় বলা হয়েছে, কোনও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কোনও কর্মী ডিএসইর স্বাধীন পরিচালক হতে পারবেন না। এমনকি, ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন স্কিমের ৪.২ এর (ই) এর ৬-এ বলা হয়েছে, স্টক এক্সচেঞ্জের কোনও ট্রেকহোল্ডার বা শেয়ারহোল্ডারের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে বা ছিল, এমন কেউ ডিএসইর স্বাধীন পরিচালক হতে পারবেন না। এদিকে (ই) এর ৭-এ বলা হয়েছে, শেয়ারবাজার মধ্যস্থতাকারী কোন প্রতিষ্ঠানে (মার্চেন্ট ব্যাংক ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিসহ) সর্বশেষ ৩ বছরের মধ্যে কর্মী বা পরিচালক হিসেবে জড়িত থাকা কেউ স্বাধীন পরিচালক হতে পারবেন। এ ছাড়া (ই) এর ১০-এ বলা হয়েছে, কোনও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কোনও কর্মী ডিএসইর স্বাধীন পরিচালক হতে পারবেন না।

সুস্পষ্ট আইন থাকার পরেও কেন বিএসইসি কে এ এম মাজেদুর রহমান, ড. মো. হেলাল উদ্দিন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. নাহিদ হোসেনকে ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে তা নিয়ে পুঁজিবাজারে সমালোচনার ঝড় বইছে বলে মনে সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, ড. নাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সরাসরি ছাত্র। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধাভোগী অর্থ মন্ত্রণালয়ের শেয়ারবাজার বিভাগের প্রধান ড. নাহিদ হোসেন। দীর্ঘদিন থেকে তিনি একই দায়িত্বে রয়েছেন। বিএসইসিতে চেয়ারম্যান হিসাবে শিবলী রুবাইয়াতের দ্বিতীয় মেয়াদের নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি পূর্ণাঙ্গ সহায়তা করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ড. আল আমিন রাইজিংবিডিকে বলেন, ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইন সঠিকভাবে পরিপালন করা হয়নি। তাই বিষয়টা নিয়ে পুঁজিবাজারের কোনও স্টেকহোল্ডাররাই সন্তুষ্ট নন। তাই বিএসইসির এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না, যেটা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এতে পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যায়। পুঁজিবাজারের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত। খুব বেশি সময়ক্ষেপণ না করে সঠিকভাবে আইন পরিপালন করে ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হলে সমালোচনা থেকে রক্ষা পাবে বিএসইসি। আগামীতে বিএসইসির যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে হবে।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক রাইজিংবিডিকে বলেন, ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক পদে নিয়োগ পাওয়া যেসব ব্যক্তিদের নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তাদের দ্রুত অপসারণ করা উচিত। বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে ডিএসই পরিচালিত হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে না।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক পরিচালক রাইজিংবিডিকে বলেন, অতিরিক্ত সচিব ড. নাহিদ হোসেন দীর্ঘদিন অর্থ মন্ত্রণালয়ে শেয়ারবাজার তদারকি করে যাচ্ছেন। তাকে ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কারণে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট দেখা দিতে পারে। তার বিরুদ্ধে সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সঙ্গে যোগসাজশ করে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। তাই তাকে বাদ দিয়ে ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালকের শূন্য পদগুলো পূরণ করা জরুরি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র ফারহানা ফারুকী রাইজিংবিডিকে বলেন, ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কে এ এম মাজেদুর রহমান ও ড. মো. হেলাল উদ্দিন তাদের পদ থেকে সরে গেছেন। এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিএসইসি।