অর্থনীতি

বিএসইসি’র নীতিনির্ধারকদের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে বাড়ছে অন্তর্দ্বন্দ্ব

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাত সংস্কার এবং পুঁজিবাজারে আস্থা পুনরুদ্ধার করা ছিল অর্থনীতির মূল চ্যালেঞ্জ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের দেড় মাসে সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশের অর্থবাজারে কিছুটা আশার আলো দেখা দিয়েছে। কিন্তু, পুঁজিবাজারের চিত্র এখনো আগের অবস্থানে আছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য গভর্নর হিসেবে অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব দিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে দেওয়া হয়েছে পুঁজিবাজারের দায়িত্ব। ব্যাংক খাত অভিজ্ঞ অভিভাবক পেলেও পুঁজিবাজার যোগ্য নীতিনির্ধারক পায়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে বিএসইসি পুনর্গঠন করা হয়েছে। কিন্তু, ইতোমধ্যে বিএসইসি’র নতুন কমিশনের বেশকিছু ভুল সিদ্ধান্ত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এমনকি, কমিশনে নিয়োগপ্রাপ্তদের দক্ষতা ও বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ফলে, পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরার পরিবর্তে বিএসইসি’র সঙ্গে বাজার মধ্যস্থতাকারীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে।

তারা আরো বলছেন, বর্তমান কমিশন হয়ত সবাইকে দুর্নীতিবাজ বা খারাপ ভাবছে। অভিভাবক হিসেবে তারা যা করছেন, তা-ই ঠিক; অন্যদের কথা শোনা বা পরামর্শ নেওয়ার দরকার নেই, এমনটা ভাবা হবে খুবই ভুল সিদ্ধান্ত। এমন চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।

গত দেড় মাস বিএসইসি’র কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, চেয়ারম্যান ও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে এখনো সচল করতে পারেনি কমিশন। স্টক এক্সচেঞ্জের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে এরইমধ্যে তিনবার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। স্টক এক্সচেঞ্জসহ বাজার মধ্যস্থতাকারীদের প্রস্তাব অবমূল্যায়ন করায় অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের (ব্রোকারেজ হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংক, অ্যাসেট ম্যানেজার, বিনিয়োগকারী ও বিশেষজ্ঞ) পরামর্শ নিয়ে সমন্বয় করার মানসিকতা কমিশনের নীতিনির্ধারকদের না থাকায় প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া, সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের দায়সারা জবাব দেওয়া এবং মন্ত্রণালয়ের কাঁধে দায় চাপিয়ে দেওয়ার ঘটনায় বিএসইসি’র নীতিনির্ধারকদের বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে বিএসইসি’র চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। একইসঙ্গে পূর্বের কমিশনের যোগ্য ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কমিশনার এ টি এম তারিকুজ্জামান এবং মোহাম্মদ মহসিন চৌধুরীসহ দুজন নতুন কমিশনার পুনরায় নিয়োগ দিয়ে বিএসইসিকে ঢেলে সাজানো হয়। এই পাঁচ সদস্যের মধ্যে কেবল এ টি এম তারিকুজ্জামানের পুঁজিবাজারে সঙ্গে সরাসরি দীর্ঘ ২৫ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা ছিল। তবে, গত ১১ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তিন মাস বা ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়ে এ টি এম তারিকুজ্জামানকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়। সরকারের ওই আদেশ জারির চার দিন পর ১৫ সেপ্টেম্বর তাকে দপ্তরবিহীন করে আদেশ জারি করেন বিএসইসি’র চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদ। পরবর্তীতে চাপ প্রয়োগ করে গত ১৭ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এ টি এম তারিকুজ্জামানকে। বিএসইসি’র এমন সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

এদিকে, গত ১ সেপ্টেম্বর ডিএসইতে সাত স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয় বিএসইসি। তাদের মধ্যে ডিএসই’র সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাজেদুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মো. হেলালউদ্দিন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. নাহিদ হোসেনের নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডিএসই’র স্বতন্ত্র পরিচালক পদে দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেন মাজেদুর ও  হেলালউদ্দিন। পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফায় তাদের স্থলে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসী চৌধুরীর অংশীদার এ এফ নেসারউদ্দিন এবং জেড এন কনসালট্যান্টের প্রধান পরামর্শক সৈয়দা জাকেরিন বখ্‌ত নাসিরকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসী চৌধুরী নিরীক্ষক এবং জেড এন কনসালট্যান্ট ডিএসই’র পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আইন অনুযায়ী স্বার্থের সংঘাতের কারণে তারাও দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। তৃতীয় দফায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসির সাবেক এমডি মোমিনুল ইসলাম এবং বহুজাতিক ওয়েলস ফার্গো ব্যাংকের সাবেক কান্ট্রি ম্যানেজার শাহনাজ সুলতানাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তৃতীয় দফাতেও প্রশ্ন ওঠে যে, ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইন ২০১৩-এর ৫ ধারার ‘কে’ উপধারায় অনুযায়ী, কেউ তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালক এবং কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি স্টক এক্সচেঞ্জের স্বতন্ত্র পরিচালক হতে পারবেন না। কিন্তু, মোমিনুল ইসলাম এক বছর আগেও তালিকাভুক্ত কোম্পানি আইপিডিসির এমডি ছিলেন। স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বারবার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থার অদক্ষতাকে ইঙ্গিত দেয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া, নতুন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করার পর দেড় মাস অতিবাহিত হলেও মন্দা পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে বাজার মধ্যস্থতাকারীদের নিয়ে এখনো কোনো বৈঠক আহ্বান করেনি। একইসঙ্গে স্টক এক্সচেঞ্জসহ বাজার মধ্যস্থতাকারীদের প্রস্তাব অবমূল্যায়ন করায় অন্তর্দ্বন্দ্ব আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে।

গত রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারিকুজ্জামানের পদত্যাগ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে বিএসইসি’র চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর দায় চাপান। তিনি বলেন, কিছু কাজ মন্ত্রণালয়ের সাথে কো-অর্ডিনেটর হয়ে করতে হয়। এই বিষয়ে পাবলিকলি কিছু বলার নেই। 

ডিএসই’র স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে বারবার ভুল এবং বাজার মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে খন্দকার রাশেদ মাকসুদ কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যান।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন রাইজিংবিডিকে বলেন, দীর্ঘ মন্দায় থাকা পুঁজিবাজারে গতিশীলতা আনতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। প্রতিদিন দেখছি, তদন্ত কমিটি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, নতুন কমিশনকে শুধু তদন্ত করার জন্যই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরছে কি না, সেই জায়গাটাও খেয়াল রাখা জরুরি। এখন কমিশন থেকে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে আরো অস্থির করে তুলছে। আমি মনে করি, তাদের আরো বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক রাইজিংবিডিকে বলেন, সম্প্রতি বিএসইসি’র সিদ্ধান্তগুলোতে ছন্দের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সিদ্ধান্তগুলো পুঁজিবাজারবান্ধব হচ্ছে না। এতে বিএসইসি’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের দূরত্ব ও অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হচ্ছে। এসবের অবসান হওয়া খুবই জরুরি। গত রোববার বিএসইসি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে হিমশিম খেতে দেখা গেছে। তাই, সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে পুঁজিবাজারে গতিশীলতা বাড়বে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি শীর্ষ মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর আমরা যেভাবে বিএসইসি’র সংস্কার চেয়েছিলাম, তা মোটেও হয়নি। বিএসইসিতে পুঁজিবাজার বিষয়ে অভিজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন নীতিনির্ধারক নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এখন কমিশনে যারা নীতিনির্ধারক পদে দায়িত্ব পালন করছেন, তারা নিজেদেরকে এতটাই জ্ঞানী ভাবছেন যে, আমাদের সঙ্গে কথা বলা বা মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না। এর মধ্যে আবার যে একজন মেধাবী ও যোগ্য কমিশনার ছিল, তাকে ষড়যন্ত্র করে তাড়ানো হয়েছে। তাই, এই কমিশনের কাছে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা পারছি না।