অর্থনীতি

পুঁজিবাজারে রক্তক্ষরণ: ‘ফোর্সড সেল’ আতঙ্কে বিনিয়োগকারীরা

দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন যেন কোনোভাবেই থামছে না। পুঁজিবাজারে রক্তক্ষরণ ক্রমেই বেড়ে চলছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই পতনের মাত্রা বাড়ছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক চার বছরে মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধারাবাহিক পতনের কারণে প্রতিদিনই পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। সব হারিয়ে তারা প্রায় নিঃস্ব। বিপর্যস্ত এই পুঁজিবাজারকে দেখার যেন কেউ নেই। এমন পরিস্থিতিতে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজগুলো থেকে বিনিয়োগকারীদের দেওয়া ঋণ সমন্বয় করতে ফোর্সড সেল (বাধ্যতামূলক শেয়ার বিক্রি) করা হচ্ছে। ফলে, বিনিয়োগকারীরা প্রতিদিন ফোর্সড সেল আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিকে নীরব ‘রক্তক্ষরণ’ বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্টরা।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, তাদের পোর্টফোলিওতে যতগুলো শেয়ার কেনা আছে, সেগুলোর দাম ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমেছে। পুঁজি হারানোর দুশ্চিন্তায় তারা রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। পুঁজি হারানোর কারণে আর্থিক টানাপোড়েন দেখা দেওয়ায় বিনিয়োগকারীদের পরিবারে অশান্তি দেখা দিচ্ছে। পুঁজিবাজার সংস্কারের নামে বিনিয়োগকারীদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অথচ, পুঁজিবাজারের এমন পরিস্থিতিতে বিএসইসি বা সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। 

টানা পতনের ফলে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এ অবস্থায় ফোর্সড সেল বন্ধ না করা হলে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে না। আগে যারা পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস (শেয়ারের দরপতনের সর্বনিম্ন সীমা) তুলে দেওয়ার জন্য যারা এতদিন উঠে-পড়ে লেগেছিলেন, এখন তারা কোথায়?

তবে বিএসইসি বলছে, পুঁজিবাজারে এ দরপতন অস্বাভাবিক। বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখছে বিএসইসি। ইতোমধ্যে অস্বাভাবিক পতন খতিয়ে দেখতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি পতনের কারণ খতিয়ে দেখবে। তবে, বিনিয়োগকারীরা যে দাবি করছেন, কমিশনের কারণে পুঁজিবাজারে দরপতন হচ্ছে, সেটা বোঝার ভুল।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রোববারের মতোই সোমবার (২৮ অক্টেোবর) উভয় পুঁজিবাজারে বড় দরপতন ঘটেছে। এদিন ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬৬.৮৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৪ হাজার ৮৯৮ পয়েন্টে, যা চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর ডিএসইর সূচক দাঁড়িয়েছিল ৪ হাজার ৯৩৪ পয়েন্টে। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে গত ১৯ আগস্ট বিএসইসির দায়িত্ব গ্রহণ করেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। সেদিন ডিএসইর প্রধান ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫ হাজার ৭৭৫ পয়েন্টে। এর পর দুই মাসে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ৮৭৭ পয়েন্টে। তার যোগদানের দুই মাসের বেশি অতিবাহিত হলেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা না বেড়ে উল্টো আরও কমেছে। এতে বিনিয়োগকারীদের হতাশা বাড়ছে।

সোমবার সকালে উভয় পুঁজিবাজারে দরপতনের মধ্যে দিয়ে লেনদেন শুরু হয়। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী এদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মতিঝিলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পুরনো ভবনের সামনে বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগ দাবিতে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন। পুঁজিবাজারের পতন রোধে দুপুর ২টার দিকে তাৎক্ষণিক করণীয় হিসেবে ১০টি দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে মানববন্ধন করেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অর্থ উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিনিয়োগকারীরা বলেন, পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে লক্ষ্যে বাংলাদেশ সিকিউরটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই), ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি), বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) এবং ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনায় বসুন। সম্মিলিতভাবে পুঁজিবাজারের সংকট দূর করার ব্যবস্থা করুন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী। এমনকি, শ্রীলঙ্কার পুঁজিবাজারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ক্রমেই পতনমুখী হচ্ছে। এর কারণ জরুরি ভিত্তিতে খুঁজে বের করা দরকার।

বিনিয়োগকারীরা আরো বলেন, ২০১০ সালে আমরা এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হইনি, যা গত আড়াই মাসে হয়েছি। ২০১০ সালে শেয়ারের দাম কমেছিল। কিন্তু, এখন পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, শেয়ারের ফেসভ্যালু ১০ টাকার নিচে নেমে এসেছে। এতে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমরা পরিবার- পরিজন নিয়ে ঠিকমতো জীবনযাপন করতে পারছি না। সরকারের কাছে আকুল আবেদন, পুঁজিবাজারের ২০ লাখ বিনিয়োগকারীকে বাঁচান। কারণ, ২০ লাখ বিনিয়োগকারীর সঙ্গে প্রায় ১ কোটি মানুষ সম্পর্কিত। আমরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে এসেছি। গত দুই মাসের টানা দরপতনের ফলে আমাদের বিনিয়োগকৃত অর্থের ৭০ শতাংশ কমে গেছে। আমরা সবাই নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমরা এখানে ভিক্ষা করতে আসিনি। আমরা এখানে পুঁজি বিনিয়োগ করতে এসেছি, যা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। অথচ, সেই পুঁজি হারিয়ে আমরা এখন নিঃস্ব। বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ওপর আমাদের আস্থা আছে। কিন্তু, বর্তমান বিএসইসির কমিশনের প্রতি বিনিয়োগকারীদের কোনেো আস্থা নাই।

ফোর্সড সেলের কারণে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব শেলটেক ব্রোকারেজ লিমিটেডের বিনিয়োগকারী মোহাম্মদ ইকবাল রাইজিংবিডিকে বলেন, মার্জিন ঋণ নিয়ে আমি ৩৬ লাখ টাকার শেয়ার কিনেছিলম। কিন্তু, পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতনের ফলে গত ২১ অক্টোবর ব্রোকারেজ হাইজ আমার শেয়ারগুলো ফোর্সড সেল করে দেয়। এতে আমি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।

গত রোববার (২৭ অক্টেোবর) বিনিয়োগকারী মোহাম্মদ ইশতিয়াকের শেয়ার ফোর্সড সেল করে এসবিএসি ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ মহসিন বলেন, সরকারের সম্মানিত উপদেষ্টারা কি দেখেন না, পুঁজিবাজারের এই দৈন্যদশা? বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেন বিলাপ করবেন? বিনিয়োগকারীরা কেন নিঃস্ব হবেন? পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক দরপতনের ফলে প্রতিদিন বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ফোর্সড সেল করা হচ্ছে। এতে প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এগুলো কি দেখার কেউ নেই? এই কমিশন পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। তাই, অতি দ্রুত বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে অপসারণ করতে হবে।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি আজাদ হোসেন বাচ্চু বলেন, মানুষ মরে  একদিন, আর আমরা বিনিয়োগকারীরা মরি প্রতিদিন। বিএসইসির চেয়ারম্যান অযোগ্য। তাকে দিয়ে এই পুঁজিবাজারে ভালো কিছু আশা করা যায় না। আমাদের টাকা গেছে। আমাদের মান-সম্মান গেছে। আমাদের আর হারানোর কিছু্ নেই। বিএসইসির চেয়ারম্যান যদি পদত্যাগ না করেন, তাহলে আমরা এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ঘোষণা করব। পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় আমি প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

এসব বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম রাইজিংবিডিকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে যে দরপতন ঘটেছে, তা অস্বাভাবিক বলে মনে করে কমিশন। বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখছে বিএসইসি। বর্তমান কমিশন স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক পুঁজিবাজার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করছে। এজন‌্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন।