দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন এনার্জি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। এখাতে বিনিয়োগের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব, সবুজ বন্ড (গ্রিন বন্ড) এবং বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে অর্থায়ন সুপারিশ করা হয়েছে।
শনিবার (২৩ নভেম্বর) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম), ‘এক্সপ্লোরিং এ সাস্টেইনেবল পাথওয়ে ফর বাংলাদেশস’ এনার্জি ট্রান্সফর্মেশন টুয়ার্ডস গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন এনার্জি’ শীর্ষক এক জাতীয় পর্যায়ের সংলাপ আয়োজন করে।
আয়োজনে সানেম-এর তিনটি গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। সংলাপে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।
সংলাপে গবেষণালব্ধ ফলাফল উপস্থাপনা করেন সানেমের জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী মো. তুহিন আহমেদ ও গবেষণা সহযোগী একরামুল হাসান।
‘জ্বালানি মূল্য ওঠানামার সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রভাব: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট’ শিরোনামে প্রথম গবেষণায় বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর বৈশ্বিক জীবাশ্ম জ্বালানির মূল্য পরিবর্তনের প্রভাব পরীক্ষা করা হয়েছে।
গবেষণার ফলাফল
গবেষণায় বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর জীবাশ্ম জ্বালানির বৈশ্বিক মূল্য ওঠানামার প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা যায়, কয়লা এবং এলএনজির (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) মূল্যবৃদ্ধি সমকালীনভাবে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই)-এর ওপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। উভয়ই সিপিআই মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে তোলে।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কয়লার দাম ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তবে সিপিআই মুদ্রাস্ফীতি ০.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আবার, এলএনজিএর দাম ১০শতাং বৃদ্ধি পেলে সিপিআই মুদ্রাস্ফীতি ০.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়।
অপরিশোধিত তেল ও কয়লার বাজারে অস্থিরতা একই সময়ে বিনিময় হারের ওপরও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, যদি অপরিশোধিত তেলের দাম ১০শতাংশ বৃদ্ধি পায় তবে বিনিময় প্রায় ০.১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায় (অথবা মুদ্রার অবমূল্যায়ন হবে)।
অন্যদিকে, যদি এলএনজি দাম ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, বিনিময় হারও একইভাবে ০.১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। এ ছাড়াও, অপরিশোধিত তেল, এলএনজি এবং কয়লার বাজারে অস্থিরতা নেট রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কয়লার দাম ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তবে নেট রপ্তানি (জিডিপির শতাংশ হিসাবে) ০.২৫ শতাংশ পয়েন্ট কমে যেতে দেখা যায়। একইভাবে, এলএনজি দাম ১০শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে নেট রপ্তানি (জিডিপির শতাংশ হিসাবে) ০.১৭ শতাংশ পয়েন্ট কমে যেতে দেখা যায়। অবশেষে, যদি অপরিশোধিত তেলের দাম ১০শতাংশ বৃদ্ধি পায়, নেট রপ্তানি (জিডিপির শতাংশ হিসাবে) ০.১৬ শতাংশ পয়েন্ট কমে যায়। তবে জ্বালানি মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি সামষ্টিক অর্থনীতির উপর কোনো উল্লেখযোগ্য সমকালীন প্রভাব নেই।
ইম্পালস রেসপন্স ফাংশনের ফলাফল স্পষ্টভাবে দেখায়, জ্বালানি মূল্য পরিবর্তনের প্রতি এক স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশন ধনাত্মক প্রভাব সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোর ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে এবং এটা নীতি গ্রহণের প্রক্রিয়াতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম। ভ্যারিয়েন্স ডিকম্পোজিশনের ফলাফল দেখায় যে, সব ধরনের জ্বালানি মূল্যের আকস্মিক পরিবর্তন প্রতিক্রিয়ায় সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। হিস্ট্রিকাল ডিকম্পোজিশন থেকে প্রমাণিত হয়, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কট, ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারি; ২০২২ সালের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি সংকটে জ্বালানির মূল্য ওঠানামা ছিল সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক পরিবর্তনের প্রধান উৎস।
অপরদিকে, জোহানসেন কোইনটিগ্রেশন টেস্টের ফলাফল নির্দেশ করে যে, সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদী সময়কালে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক এবং বিভিন্ন জ্বালানি মূল্যের মাঝে একটি সম্পর্ক বিদ্যমান। অতএব, জ্বালানি মূল্য ওঠানামা দীর্ঘমেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে, যা সরকারের উন্নয়ন লক্ষ্য। যেমন ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ২০২৫, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০, ২০৩১ সালের মাঝে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হওয়া এবং ২০৪১ সালের মাঝে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ প্রভৃতি অর্জনে বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
নীতি প্রস্তাবনা
এই গবেষণার ফলাফল নির্দেশ করছে, সরকারি নীতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, যাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে, নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব শক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। এর ফলে পরিবেশের উন্নয়ন ঘটবে, অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকবে এবং টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে। তাই, গবেষণাটি কিছু সুপারিশও করেছে, যেমন জ্বালানির উৎস বৈচিত্র্যকরণ, কার্যকর মুদ্রানীতি সামঞ্জস্য, গতিশীল মূল্য সমন্বয় প্রক্রিয়া, জ্বালানি পরিকল্পনার পুনর্মূল্যায়ন; কৌশলগত জ্বালানির মজুতাগার গঠন, জ্বালানি অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দক্ষ প্রযুক্তি গ্রহণ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ। এসব নীতি গ্রহণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব।
‘বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ ও শক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানের গুণমান এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির গতিবিধির মূল্যায়ন’ শিরোনামে দ্বিতীয় গবেষণাটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রাতিষ্ঠানিক মান এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির গতিশীলতা মূল্যায়ন করেছে।
গবেষণার ফলাফলে যা বলা হয়েছে
বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে প্রাতিষ্ঠানিক মানের দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা স্পষ্ট। ২০১০ সালের ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ দ্রুত বৃদ্ধির (বিশেষ বিধান) আইন’ (২০২১ সালে সংশোধিত) প্রতিযোগিতামূলক বিডিং উপেক্ষা করে উচ্চ বিদ্যুৎ মূল্য নির্ধারণ করে এবং ২০০৬ সালের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইনকে অগ্রাহ্য করে, যা বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি)-এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দুর্বল করেছে। ২০২৩ সালের বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন সংশোধনের মাধ্যমে সরকার বিশেষ পরিস্থিতিতে একতরফাভাবে জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে, যা জনশুনানি বাদ দিয়ে অস্বচ্ছ বাজার সৃষ্টি করেছে। সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে দুর্বল সমন্বয় নীতিগত সামঞ্জস্যের অভাবকে নির্দেশ করে এবং দীর্ঘমেয়াদে নীতির কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে এর ক্ষমতা সীমিত এবং বিপিডিবি-এর নবায়নযোগ্য জ্বালানি শাখা সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাধান্য বিস্তার করায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কেন্দ্রীভূত বাজার কাঠামোর ফলে বিপিডিবি একক ক্রেতা হিসেবে কাজ করে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ সীমিত হচ্ছে। ২০২৫ সালে এ জ্বালানি খাতের ভর্তুকির ৮০ শতাংশ (৩২ হাজার কোটি টাকা) ক্যাপাসিটি চার্জে বরাদ্দ, যা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর সুবিধা নিশ্চিত করেছে। কয়লা, গ্যাস, এলএনজি এবং পারমাণবিক প্রযুক্তি সোলার প্রযুক্তির তুলনায় বেশি রেন্ট সিকিং এর সুযোগ দেয় এবং গত ১৪ বছরে ১ ট্রিলিয়ন টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদক (আইপিপি) এবং ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পেয়েছে। স্বচ্ছতার অভাবে প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ায় অপ্রতিযোগিতামূলক ও গোপনীয়তা ছিল, যা বিদ্যুৎ ক্রয় মূল্য এবং অকার্যকর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ন্যায্যতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। সর্বোপরি দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত দীর্ঘদিন ধরে সমস্যাগ্রস্ত।
অংশীজন জরিপের ফলাফল
গবেষণার অধীনে করা জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, নবায়নযোগ্য জ্বালানির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে অংশীজনদের পারস্পারিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। সরকারি সংস্থা, বেসরকারি খাত, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে, যা জ্বালানি রূপান্তর সফল করতে অপরিহার্য। এতে স্পষ্ট যে, একক কোনো সংস্থা দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। তাই প্রযুক্তিগত, আর্থিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। জরিপে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য সচেতনতা দেখা গেছে, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সাধারণ ধারণা প্রকাশ করেছেন। তবে নীতিমালার কার্যকারিতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে; মাত্র ৫৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বর্তমান নীতিমালাকে কার্যকর বলে মনে করেন এবং ২৯ শতাংশ নীতিমালার পর্যাপ্ততা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
জরিপে দেখা যায়, ৩৮.২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন, বাংলাদেশে বর্তমান নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ও প্রণোদনা কার্যকর নয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় সৌরচালিত সেচ ব্যবস্থার বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে। সৌরশক্তিকে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও কার্যকর সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, যা দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাস্তবসম্মতও।
প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা এবং অংশীজনদের প্রভাবও এ জরিপে উঠে এসেছে। ৮৫.৩৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন, নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোর উচ্চ সক্ষমতা রয়েছে। অপরদিকে, ৪২.৪৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি কোম্পানিগুলোর এই উচ্চ সক্ষমতা রয়েছে। সরকারি সংস্থা এবং জীবাশ্ম জ্বালানি প্রতিষ্ঠানগুলো জ্বালানি নীতিমালা গঠনে সবচেয়ে প্রভাবশালী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবু, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকে অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা হয়েছে, যা শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব এবং আরও সুস্পষ্ট নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
বাংলাদেশের ২০৪১ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্য অর্জনকে অনেকেই শঙ্কামিশ্রিত আশাবাদ নিয়ে দেখছেন। অংশহণকারীদের প্রায় অর্ধেক (৪৫.৩৬ শতাংশ) এই রূপান্তরকে সম্ভব বলে মনে করেন, তবে অবকাঠামোগত প্রস্তুতি এবং বিনিয়োগ নিয়ে তাদের মাঝে উদ্বেগ রয়েছে। ৪২.৫৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বেসরকারি বিনিয়োগের অভাবকে একটি বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জমির অভাবও বড় আকারের নবায়নযোগ্য প্রকল্প সম্প্রসারণকে সীমিত করছে।
এসকল প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বের মতো লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব, যদি সঠিক কৌশলগত বিনিয়োগ, নীতি সংস্কার এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। চিহ্নিত বাধাগুলো দূর করে বাংলাদেশ পরিবেশগত সুবিধার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি টেকসই জ্বালানি নির্ভর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে।
নীতি প্রস্তাবনা
বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির রূপান্তর ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে একটি সমন্বিত ও স্বচ্ছ নীতিগত কাঠামো গ্রহণ করা জরুরি। মূল পদক্ষেপসমূহের মধ্যে রয়েছে ২০১০ সালের ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ দ্রুত বৃদ্ধির (বিশেষ বিধান) আইন’ বাতিল করা, আইইপিএমপি ২০২৩ সংশোধন করে জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক ও অকার্যকর বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-এর সক্ষমতা পুনরুদ্ধারে বিস্তৃত সংস্কার। বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরঞ্জামের ওপর উচ্চ শুল্ক-ব্যবস্থার বিলুপ্তি, কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে ভর্তুকি চালু করা এবং জ্বালানি দক্ষতার জন্য আর্থিক প্রণোদনা প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায্যতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে প্রকল্প টেন্ডারিং, বিনিয়োগকারী নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদকদের (আইপিপি) চুক্তিগুলো পুনর্মূল্যায়ন করে ‘বিদ্যুৎ না দিলে, টাকা নয়’ শর্ত সংযোজন ভূমিকা রাখবে। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ক্ষমতা ও সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন। শক্তিশালী তদারকি ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে নীতির অসামঞ্জস্য দূর করা, অপব্যবস্থাপনা রোধ করা এবং দেশের জ্বালানি রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব।
‘বাংলাদেশে ২০৪১ সালের মাঝে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজনীয়তার মূল্যায়ন,’ শিরোনামে তৃতীয় গবেষণাটির প্রধান উদ্দেশ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য, বিশেষত সৌর এবং বায়ু বিদ্যুৎ উন্নয়নে, প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ধারণ করা। গবেষণাটিতে শক্তি সংরক্ষণ ব্যবস্থার সংযুক্তির সম্ভাব্যতা মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন অর্থায়ন প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য ফলাফল
বাংলাদেশের বর্তমান নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ক্ষমতা ১২১৯.২৪ মেগাওয়াট, যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র ৪.১৬ শতাংশ। যা নির্দেশ করে, ভবিষ্যৎ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের প্রয়োজন। গবেষণায় ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য তিনটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি ব্যবহার করা হয়েছে: (১) ৪০,০০০ মেগাওয়াট (২) ৮,১৭৩ মেগাওয়াট এবং (৩) ৪৯,৫৩৩.৩ মেগাওয়াট (বেইজ লোড ছাড়া সম্পূর্ণ রূপান্তর)। প্রতি মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের খরচ দুটি অনুমানের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হয়েছে: সর্বনিম্ন খরচ ০.৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ১.৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সর্বনিম্ন খরচের ক্ষেত্রে, প্রথম পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হবে ৩৬.৩ বিলিয়ন ডলার, দ্বিতীয় পরিস্থিতিতে ৬.৭ বিলিয়ন ডলার, এবং তৃতীয় পরিস্থিতিতে ৪৫.২ বিলিয়ন ডলার। সর্বোচ্চ খরচের ক্ষেত্রে এই পরিমাণগুলো বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে ৫২.১ বিলিয়ন ডলার, ৯.৭ বিলিয়ন ডলার এবং ৬৪.৮ বিলিয়ন ডলার হয়।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে কোনো পরিবর্তনশীল ব্যয় নেই, তবে স্থায়ী পরিচালনা ব্যয় রয়েছে। মূলধন ব্যয় এবং স্থায়ী পরিচালনা ব্যয় সহ, সর্বনিম্ন খরচের অনুমানে মোট বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে প্রথম পরিস্থিতিতে ৬০.৩১ বিলিয়ন ডলার, দ্বিতীয় পরিস্থিতিতে ১১.১৫ বিলিয়ন ডলার, এবং তৃতীয় পরিস্থিতিতে ৭৫.০৮ বিলিয়ন ডলার। সর্বোচ্চ খরচের অনুমানে এই পরিমাণগুলো যথাক্রমে ৭৬.১৩ বিলিয়ন ডলার, ১৪.১১ বিলিয়ন ডলার এবং ৯৪.৭২ বিলিয়ন ডলার। গবেষণায় ২০২৫ থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত প্রতিটি পরিস্থিতির জন্য বছরে বছরে বিনিয়োগ পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে, যা জিডিপির তুলনায় ন্যূনতম। তবে উচ্চ প্রাথমিক খরচ, বিশেষত শক্তি সঞ্চয়ের জন্য, একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। যদিও বৈশ্বিকভাবে ব্যাটারির খরচ কমার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য শক্তি সঞ্চয় ব্যবস্থা বর্তমানে ব্যয়বহুল।
নীতি প্রস্তাবনা
প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সংগ্রহের জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব, সবুজ বন্ড (গ্রিন বন্ড) এবং বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে অর্থায়ন সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি অনুদান, ঋণ এবং ইক্যুইটির মিশ্রণে একটি বিশেষায়িত নবায়নযোগ্য জ্বালানি তহবিল গঠিত হলে তা ছোটো ও মাঝারি নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পগুলোকে সহায়তা করতে পারে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং কার্যকরী ব্যয় পরিচালনার জন্য কর প্রণোদনা এবং ঝুঁকি গ্যারান্টি সহায়ক নীতিমালা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।