অর্থনীতি

মরার উপর খাঁড়ার ঘা: বেক্সিমকোকে জনতা ব্যাংকের আরও ১৮০ কোটি টাকা ঋণ 

মরার উপর খাঁড়ার ঘা: বেক্সিমকোকে জনতা ব্যাংকের আরও ১৮০ কোটি টাকা ঋণ 

বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন বাবদ ১৮০ কোটি টাকা ছাড়ের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। এরআগে কয়েকজন উপদেষ্টার উপস্থিতিতে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিয়ে এক সভায় এই শিল্প গ্রুপের শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়, সে অনুযায়ী এই অর্থ ছাড় করা হচ্ছে।

চরম আর্থিক সঙ্কটে থাকা রাষ্ট্রীয় এই ব্যাংকের পক্ষে এই অর্থ ছাড় করতে রীতিমত হিমসিম খেতে হচ্ছে বলে জানা গেছে। কারণ অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, পুরো অর্থ জনতা ব্যাংককেই দিতে হবে। ভবিষ্যতে এই অর্থ জনতা ব্যাংক সরকারের কাছে দাবি করতে পারবে না। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও অর্থ বিভাগ সূত্র এ তথ্য জানা গেছে।

বেক্সিমকো গ্রুপের কাছে জনতা ব্যাংকের ঋণ পাওনা রয়েছে সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় বেক্সিমকো গ্রুপ জনতা ব্যাংকের কাছে ঋণ খেলাপি হয়ে রয়েছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বেক্সিমকো গ্রুপের দায়দেনা নিয়ে সচিবালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম, শ্রম উপদেষ্টা ব্রি.জে. (অব.) সাখাওয়াত হোসেনসহ জনতা ব্যাংক ও অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকে বেক্সিমকো শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন বাবদ ১৮০ কোটি টাকা ছাড় করার সিদ্ধান্ত হয়। 

এ সময়ে জনতা ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা করা হয়, বেক্সিমকোর কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। তারা এই ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে আবার নতুন করে এই গ্রুপকে ১৮০ কোটি দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এ সময় দুই জন উপদেষ্টা জানান, শ্রমিকদের বেতন দেওয়া সম্ভব না হলে আইনশৃংখলার অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। যা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করবে, তাই বেতনের অর্থ জনতা ব্যাংককেই দিতে হবে।

বেক্সিমকো শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনের দাবিতে শিল্প এলাকাগুলোতে ক্রমাগত আন্দোলনের মুখে সরকার গত ২৪ নভেম্বর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রি.জে.(অব.) ড.এম সাখাওয়াত হোসেনকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে। গত ২৮ নভেম্বর কমিটির প্রথম সভা হয় ।

সভায় সিদ্ধান্ত হয়-

১. বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রমিকদের আগামী ৩ মাসের বেতনের প্রয়োজনীয় অর্থ জনতা ব্যাংক যোগান দেবে।

২. বেক্সিমকোর  কোম্পানিসমূহের মধ্যে ‘বি’ ক্যাটাগরির' কোম্পানিসমূহের স্বত্ব বিক্রির লক্ষ্যে এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) চূড়ান্ত করে ঋণ প্রদানকারী জনতা ব্যাংক আগামী ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে।

৩. হাইকোর্ট বিভাগে চলমান রিটের জবাব প্রস্তুতের লক্ষ্যে একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করে রিসিভারের টিওআর চূড়ান্তকরণ ও রিটের জবাব যথাযথভাবে প্রয়োজনীয় সাপোর্টিং ডকুমেন্টস-সহ বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে প্রেরণ করা হবে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থ অর্থবিভাগ সংস্থান করবে।

৪. আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে বেক্সিমকোর কোম্পানিগুলোর শেয়ার হস্তান্তরের নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করবে।

জানা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে গত সপ্তাহে অর্থ দেওয়ার বিষয়ে মতামত চেয়ে অর্থ বিভাগের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এই চিঠির জবাবে অর্থ বিভাগের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের পক্ষ থেকে গত ১০ ডিসেম্বর মতামত দিয়ে বলা হয়, “বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় জনতা ব্যাংক পিএলসি কর্তৃক বেক্সিমকো গ্রুপের অনুকূলে ১৮০ কোটি টাকা ঋণ প্রদানে অর্থ বিভাগের অনাপত্তি দুই শর্তে নির্দেশক্রমে অবহিত করা হলো। এর একটি শর্ত হলো- ক. ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ২৭ক ও ২৬খ নং ধারা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে জনতা ব্যাংকের সম্পাদিত এমওইউ এর শর্ত ব্যত্যয় হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বসম্মতি গ্রহণ করতে হবে। এবং খ. এই ঋণের প্রেক্ষিতে অর্থ বিভাগের কোনো দায় তৈরি হবে না এবং এর বিপরীতে সরকার থেকে কোনো ধরণের অর্থ সহায়তা জনতা ব্যাংক ভবিষ্যতে দাবি করতে পারবে না।”

এই বিষয়ে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এমনিতে আমরা চরম অর্থ সঙ্কটে আছি। কয়েক বছর ধরে আমরা সঞ্চিতির ঘাটতিতে ভূগছি। বিধিবদ্ধ অর্থ রাখতে না পারার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের অর্থও জরিমানা করেছে। এই গ্রুপের কাছে আমাদের পাওনা রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এরপর নতুন করে আরও ১৮০ কোটি ঋণ দেওয়া আমাদের পক্ষে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ালেও সরকারের নির্দেশ মেনে এই অর্থ আমাদের ছাড় করতে হচ্ছে। কিন্তু এই অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

জানা গেছে, ২০২৪ সালে বেক্সিমকো গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে প্রচুর পরিমান ঋণ নিয়েছে। ২০২১ সালে জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকোর ঋণ ছিল ১৪ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা, এখন যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৪৮২ কোটি টাকায়। এই ঋণের বেশির ভাগই খেলাপি। এখন আবার নতুন করে শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ করছে গ্রুপটি।