ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ থেকে থেকে শুরু দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নের স্বাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন আজ। দেশের প্রথম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে দেশের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই প্রতিষ্ঠানটির। ১ জুলাই গৌরবের পথচলায় এক শতাব্দী পেরিয়ে দ্বিতীয় শতাব্দীতে পা দিয়েছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।
১৯২১ সালের এই দিনে ঢাকার রমনা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশ সরকারের পরিত্যক্ত ভবনগুলো ও ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনগুলোর সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৪৭ জন শিক্ষার্থী এবং ৩টি আবাসিক হল নিয়ে ১৯২১ সালের ১ জুলাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ৮৪টি বিভাগ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ১৯৮৬ জন শিক্ষক, প্রায় ৪৭ হাজার শিক্ষার্থী এবং ১৯টি আবাসিক হল ও ৪টি হোস্টেল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে দেড় শতাধিক বিভিন্ন একাডেমিক ঘরানার অধিভুক্ত/উপাদানকল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
দেশব্যাপী চলমান করোনাভাইরাসের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১০১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সশরীরে আজ বৃহস্পতিবার ক্যাম্পসে কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে না। অনলাইনে প্রতীকী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি। প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রকাশ করেছেন তাদের আবেগ-অনুভূতি আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী জাহানারা লুতফা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানেই এক জীবন্ত ইতিহাস।এ ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস। রচিত হয়েছে নানা অধ্যায়। বটতলা, মধুর ক্যানটিন, কলাভবন, শহীদ মিনার এমন কোনো জায়গা নেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের, যেখানে বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাস তার কোনো কোনো পর্ব উন্মোচন করেনি। শুভ জন্মশতবর্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যতদিন অস্তিত্ব আছে, তুমি থাকবে প্রতিটি নিঃশ্বাসে। তাই প্রিয় শন্তানকেও এ মাটির ঘ্রাণ নিতে শিখিয়েছি।যাতে বড় হয় চেনা এ প্রাঙ্গণেই নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায়।
২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সফিউল ইসলাম বলেন, স্বপ্ন যেখানে অন্তহীন, যার জন্য আকুলতা বিরামহীন। কেবল শতবর্ষ নয়, পৃথিবীর সমান স্থায়িত্ব হোক স্বপ্নের বাতিঘরের।
২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোবারক হোসেন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্তি অনেক, ঋণী আমি এই ক্যাম্পাসের কাছে নিঃসন্দেহে। চেষ্টা করবো কোনো না কোনো দিন কিছুটা হলেও ঋণ পরিশোধের।
২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শারমিন মাওয়া বলেন, এটি আমার প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়। স্বপ্নের এ প্রতিষ্ঠান ১০১ বছরে পা রেখেছে। শতবর্ষে অর্জন এ প্রতিষ্ঠানের কতটুকু আর ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার ১০০ বছর অতিক্রম করেছে। ইতিহাস ঐতিহ্যের অন্যতম অংশীদার এ প্রতিষ্ঠান। বাংলাদের ইতিহাসের সুতিকাগার এ বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান হবে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ স্বাক্ষর রেখে যাবে এটাই প্রত্যাশা।
শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চিরগৌরবময় মুক্তিযুদ্ধসহ গণমানুষের সব লড়াইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদা নেতৃত্ব দিয়েছে। জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং দেশ সেবায় রেখেছে অনন্য অবদান। দেশের প্রতি আমাদের মমত্ববোধ ও চিরকৃতজ্ঞ চিত্তই এগিয়ে চলার পাথেয়। ইনশাল্লাহ, আমরা এগিয়ে যাবই।
তিনি বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন গর্বিত শিক্ষার্থী বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিস্ময়কর অভিযাত্রার নিরবচ্ছিন্ন সঙ্গী হয়ে এই জ্ঞানপীঠ যেন পৃথিবীর সাম্প্রতিকতম জ্ঞানকে আরও বেশি আয়ত্ত করার সাধনায় নিয়োজিত থাকতে পারে- বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে সেটাই হোক প্রত্যাশা।
করোনা পরিস্থিতির কারণে আজ শতবর্ষ উপলক্ষে অনলাইন প্রতীকী কর্মসূচির অংশ হিসেবে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে বিকেল ৪টায় এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভা হবে। এতে মূল বক্তা হিসেবে সংযুক্ত থাকবেন ভাষাসৈনিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তিনি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ: ফিরে দেখা’ শীর্ষক মূল বক্তব্য প্রদান করবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তির মূল অনুষ্ঠান জাঁকজমকপূর্ণভাবে আগামী ১ নভেম্বর হবে বলে বিশ্ববিদ্যালয় জনসংযোগ দপ্তর থেকে জানানো হয়। ওইদিন নানাবিধ আয়োজনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে শতবর্ষের মূল অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন।
১৯২১ সালে তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। কলা, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদের অন্তর্ভুক্ত বিভাগগুলো ছিল— সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, শিক্ষা, ইতিহাস, আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারসি ও উর্দু, দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত এবং আইন।
প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। যেসব প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন, তারা হলেন— হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফ. সি. টার্নার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, জি এইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউ এ জেনকিন্স, রমেশচন্দ্র মজুমদার, এ এফ রহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অস্থিরতা ও দেশভাগের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বা পরবর্তী সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা উজ্জীবিত হয়। নতুন উদ্যোমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। তৎকালীন পূর্ববাংলার ৫৫টি কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। ১৯৪৭-৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৫টি নতুন অনুষদ, ১৬টি নতুন বিভাগ ও ৪টি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে সব জন-আন্দোলন ও সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। স্বাধীনতা যুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। এতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছাত্র-ছাত্রীসহ শহীদ হয়েছেন অনেকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে ১৯৬১ সালের আইয়ুব সরকারের জারি করা অর্ডিন্যান্স বাতিলের জন্য ষাটের দশক থেকে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই অর্ডিন্যান্স বাতিল করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ-১৯৭৩ জারি করেন। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে এবং পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়।