এসএসসি ও এইচএসসিতে বরাবরই মেধা তালিকার শীর্ষে থাকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। কিন্তু দেশের অন্যতম সেরা এই বিদ্যাপীঠকে ঘিরে এখন বিতর্ক এবং সমালোচনার ঝড় বয়ে চলেছে।
ফাঁস হওয়া দুটি ফোনালাপকে কেন্দ্র করে সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রশাসন। অধ্যক্ষ কামরুন নাহারের সঙ্গে অভিভাবক ফোরামের নেতা মীর সাহাবুদ্দিন টিপুর কথোপকথন এবং আরেক শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর ঝগড়াটে ফোনালাপ বিস্ময়, হতাশা, আতঙ্ক এবং অবক্ষয়ের বর্ণনাই দিচ্ছে!
অধ্যক্ষের সঙ্গে চলা ফোনালাপে ‘নাসির’ নামে যাকে উদ্দেশ্য করে আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগ করা হচ্ছিলো, তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদে মাধ্যমিক স্কুল শাখার অভিভাবক প্রতিনিধি সিদ্দিকী নাসির উদ্দিন। তবে অধ্যক্ষ কামরুন নাহার বলেছেন, এটি তার কণ্ঠ নয়। ‘সুপার এডিট’ করে এটি ছাড়া হয়েছে।
এই ফোনালাপ ফাঁসের পর বিরোধের উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভিকারুননিসায় শিক্ষার্থী ভর্তিতে টাকা লেনদেন ও উন্নয়ন কাজে আর্থিক সুবিধা নিয়ে দুটি পক্ষের মধ্যে বিরোধের তথ্য পাওয়া গেছে।
বিরোধের একটি পক্ষে আছেন অধ্যক্ষ কামরুন নাহার, অপর পক্ষে আছেন অভিভাবক ফোরাম ও পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্য।
গত ১৮ জুলাই ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি বাণিজ্য, উন্নয়ন কাজে আর্থিক অনিয়ম ও শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্যের অশোভন আচরণের অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের পর থেকেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দুই পক্ষের বিরোধ।
গত ১৯ জুলাই ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি স্কুলে পাঠানো হয়। কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক আবু তালেব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে শিক্ষকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ, ভর্তিসহ কলেজের যাবতীয় কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ, ভর্তি বাণিজ্য ও কলেজের উন্নয়ন ও সংস্কারমূলক কাজে আর্থিক অনিয়মের চেষ্টার কথা উল্লেখ আছে।
এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের কমিটিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক আবুল মনছুর ভূঞাকে আহ্বায়ক করে উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (সনদ) হেলাল উদ্দিন ও উপ-কলেজ পরিদর্শক রবিউল আলমকে সদস্য করা হয়। প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে তাদেরকে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে বোর্ডের কলেজ পরিদর্শকের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
এদিকে, গত ১৯ জুলাই ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে অভিভাবক ফোরাম স্কুলে গরুর হাট বসানোর ঘটনায় অধ্যক্ষ কামরুন নাহারের অপসারণ দাবি করেন।
ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ সুজন বলেন, ‘স্কুলে ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি হাউজ অ্যান্ড ডেকোরেটর অবৈধভাবে গরু-ছাগলের হাট বসায়। এ জন্য অধ্যক্ষকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়। অভিভাবকদের নেতৃত্বে গত ১৬ জুলাই তা উচ্ছেদ করা হয়।’
তবে অধ্যক্ষ এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘স্কুলে গরুর হাট বসেনি। স্কুলের বাইরে ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি হাউজ অ্যান্ড ডেকোরেটর যে জায়গা ব্যবহার করে, সেখানে বসেছিল।’
অভিযোগ উঠেছে, এবারের ভর্তি লটারির সময় স্কুলে ১২০টি আসন খালি রাখা হয়। এছাড়া আরও কিছু আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫০টি আসন খালি ছিল। এগুলোতে ভর্তির জন্য চাপ দিতে থাকে ব্যবস্থাপনা কমিটির কয়েকজন সদস্য।
অধ্যক্ষের দাবি—তিনি এতে রাজি হননি বলেই তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘অভিভাবক ফোরাম চায়, আমি যেন কিছু আসন ফাঁকা রাখি, যেন ভর্তি বাণিজ্য করা সম্ভব হয়। যা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমার ইতিহাসে অন্যায়ের কোনো দাগ নেই।’
ভিকারুননিসা পরিচালনা পর্ষদের সদস্য (কলেজ শাখা) মনিরুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘স্কুলে অনেকগুলো আসন ফাঁকা আছে। আমরা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই ফাঁকা আসনগুলো পূরণ করতে বলেছি। এটাকে চাপ বলা যায় না।’
অধ্যক্ষ বলেন, ‘শুধু ভর্তি বাণিজ্যই নয়, তারা (ম্যানেজিং কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধিরা) কলেজ ফান্ডের টাকাও লুটপাট করতে চাচ্ছে। কিছু দিন আগে তারা পৌনে দুই কোটি টাকার ভুয়া বিল দিয়েছে। আমি এই টাকা না দেওয়ায় তারা আমার ঘরে তালা পর্যন্ত দিয়েছে। আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনও মাথা নত করিনি, ভবিষ্যতেও করব না।’
পরিচালনা পর্ষদের সদস্য (কলেজ শাখা) মনিরুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘অনৈতিকভাবে কোনো আর্থিক সুবিধা নেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যদি আমরা এমন কাজ করে থাকি, তাহলে উনি অবশ্যই সুনির্দিষ্ট ফোরামে বলতে পারেন। যদি কেউ অর্থ তছরুপ করে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে।’
এদিকে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ এবং স্কুলের অভিভাবক প্রতিনিধির মধ্য ফোনালাপের অডিও ভাইরাল হওয়ার পর বিষয়টি তদন্তে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে গঠিত এ তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বুধবার (২৮ জুলাই) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নিরীক্ষা ও আইন) খালেদা আক্তারকে সভাপতি করে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রণালয়। কমিটির অপর সদস্য হলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন। কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।