রাহাত সাইফুল : ঢাকাই চলচ্চিত্রের যাত্রা লগ্ন থেকে অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব জড়িত ছিলেন। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবদানের ফলে আজকের চলচ্চিত্র শিল্প। তাদের অনেকেই আজ আমাদের মাঝে নেই। নিয়তির এক অমোঘ নিয়মে তারা পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। মৃত্যুজনিত শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তবুও চিরাচরিত এ নিয়মে বিভিন্ন বছর এই নভেম্বর মাসে চিরতরে হারিয়েছে অনেক গুণী অভিনয়শিল্পীকে। এ মাসে ঢাকাই চলচ্চিত্রাঙ্গন যাদেরকে হারিয়েছে প্রয়াত এ গুণীদের স্মরণে এই বিশেষ প্রতিবেদন।
সুভাষ দত্ত (নির্মাতা, অভিনেতা) : দেশে সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে অন্যতম সুভাষ দত্ত। তিনি একাধারে সিনেমা নির্মাতা ও অভিনেতা। ষাটের দশক থেকে বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি পরিচিত মুখ। তার কর্মজীবনের শুরু সিনেমার পোস্টার এঁকে। এ দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’এর পোস্টার ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। ‘মাটির পাহাড়’ চলচ্চিত্রে আর্ট ডিরেকশনের মাধ্যমে তার পরিচালনা জীবন শুরু। এরপর তিনি এহতেশাম পরিচালিত এ দেশ তোমার আমার সিনেমায় প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পান। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সুতরাং’ (১৯৬৪) এবং সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ও আমার ছেলে’ ২০০৮ সালে মুক্তি পায়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে তার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৯৯ সালে একুশে পদক প্রদান করা হয়। এ ছড়াও তিনি দেশি-বিদেশি অসংখ্য সম্মাননা লাভ করেছেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এ গুণী ব্যক্তি ২০১২ সালের ১৬ নভেম্বর পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তিনি দুই ছেলে, দুই মেয়ে, পুত্র-পুত্রবধূ, নাতি নাতনী রেখে গেছেন। বড় ছেলে শিবাজী দত্ত দেশে থাকেন, আর ছোট ছেলে রানাজী দত্ত থাকেন সুইডেনে। বড় মেয়ে শিল্পী দত্ত বরিশাল এবং ছোট মেয়ে শতাব্দী দত্ত রংপুরে স্বামীর বাড়িতে থাকেন।
রাজীব (অভিনেতা) : ঢাকাই চলচ্চিত্রের শক্তিমান অভিনেতা ওয়াসীমুল বারী রাজীব। তিনি রাজীব নামেই পরিচিত। প্রায় দুই শতাধিক বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এই অভিনেতা। খলনায়ক হিসেবে সফল হলেও অনেক চলচ্চিত্রে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রেও অভিনয় করেছেন তিনি। তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের হলো- ‘দাঙ্গা’ (১৯৯২),‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ( ১৯৯৩), ‘বিক্ষোভ’ (১৯৯৪), ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ (১৯৯৭), ‘ভাত দে’ (১৯৮৪), ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ (১৯৯৬), ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ ( ১৯৯৬), ‘মগের মুল্লুক’ (১৯৯৯), ‘স্বপ্নের বাসর’ ( ২০০১) প্রভৃতি।
শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। বিএফডিসির ব্যবস্থাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন রাজিব। দাপুটে এ অভিনেতা তার অসংখ্য ভক্তকে কাঁদিয়ে ২০০৪ সালের ১৪ নভেম্বর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
ব্ল্যাক আনোয়ার (কমেডি অভিনেতা) : জনপ্রিয় কমেডি অভিনয়শিল্পী ব্ল্যাক আনোয়ার। তিনি ঢাকার সুত্রাপুরে ১৯৪১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সোনা মিয়াও ছিলেন একজন অভিনয়শিল্পী। তিনি চলচ্চিত্রের পাশাপাশি টেলিভিশন ও মঞ্চে অভিনয় করেন। ‘সুয়ো রানী দুয়ো রানী’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘সাক্ষী’, ‘সৎভাই’সহ জনপ্রিয় সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। সর্বশেষ তিনি ‘কাবলিওয়ালা’ সিনেমায় অভিনয় করেন। হাসির এ মানুষটি সবাইকে কাঁদিয়ে ২০০৭ সালে ১০ নভেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান।
হানিফ চাচা (অভিনেতা) : চলচ্চিত্রাঙ্গনের পরিচিত অভিনেতা এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির পূর্ণ সদস্য হানিফ চাচা। তিনি অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ২০১৩ সালে ২৬ নভেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। তিনি স্ত্রী, ১ ছেলে, ১ মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
হাসমত (অভিনেতা) : ঢাকাই চলচ্চিত্রের অতি পরিচিত মুখ হাসমত। তিনি তার সহজ সরল অভিনয় দিয়ে হাসিয়েছেন দর্শকদের। এজন্য তিনি হাবা হাসমত নামেই অধিক পরিচিত। অসংখ্য বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। হাসির এ মানুষটি ২০০৪ সালে ১০ নভেম্বর অসংখ্য ভক্তকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান।
আজাদ (অভিনেতা) : ঢাকাই চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনেতা ছিলেন আজাদ। তিনি বাংলাদেশের অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ১৯৯৯ সালে ৬ নভেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান এই অভিনেতা।
মতি (অভিনেতা) : বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পী মতি। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করছেন। ১৯৯৩ সালে ১৬ নভেম্বর পরোলোক গমন করেন এ অভিনেতা।
আশীষ কুমার লোহ (অভিনেতা) : জনপ্রিয় ‘ত্রিরত্ন’ নাটকে হীরা চুনি পান্না চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আশীষ কুমার লোহ। ঢাকাই চলচ্চিত্রের কমেডি অভিনেতা ছিলেন তিনি। তার অভিনয় দিয়ে হাসিয়েছেন অসংখ্য দর্শককে। ১৯৯৪ সালে ৪ নভেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান লোহ।
মায়া হাজারিকা (অভিনেতা) : উচ্চ বিত্তের দ্বিচারিণী স্ত্রীর ভূমিকায়, মায়া হাজারিকার সমকক্ষ কেউই ছিলেন না। ক্লাবে গিয়ে মদ খাওয়া, পর পুরুষের সঙ্গে প্রেম, সংসারে ভাঙ্গন ধরানোর জন্য ষড়যন্ত্র, এসব চরিত্রে তিনি অভিনয় করতেন। তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পেলেও অভিনয় করেছেন অসংখ্য জনপ্রিয় সিনেমায়। তার উল্লেখযোগ্য সিনেমার হলো- ‘ভালো মানুষ’, ‘সীমানা পেরিয়ে’ অন্যতম। জনপ্রিয় এ শিল্পী ১৯৯৬ সালের ৬ নভেম্বর পরোলোক গমন করেন।
জহিরুল হক (অভিনেতা) : বাংলাদেশে শিল্পী সমিতির সদস্য জহিরুল হক। ঢাকাই চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। ১৯৯৩ সালের ২৫ নভেম্বর পরোলোক গমন করেন এ অভিনেতা।
মেহফুজ (অভিনেতা) : মেহফুজ ঢাকাই চলচ্চিত্রের নিয়মিত অভিনয়শিল্পী ছিলেন। অভিনয় করেছেন বেশ কিছু চলচ্চিত্রে। ২০০৫ সালে ২ নভেম্বর পরোলোক গমন করেন এ অভিনেতা।
সুচনা (অভিনেত্রী) : বাংলাদেশে চলচ্চিত্রে পরিচিত মুখ সুচনা। তিনি অভিনয় করেছেন বেশকিছু চলচ্চিত্রে। ২০১০ সালের ২০ নভেম্বর পরোলোক গমন করেন সুচনা।
টুল্লুরাহী (অভিনেতা) : ঢাকাই চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পী টুল্লুরাহী। তিনি ২০১০ সালে ৫ নভেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ নভেম্বর ২০১৬/রাহাত/শান্ত