আমিনুল ইসলাম শান্ত : নব্বই দশকের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক আমিন খান। অভিনয় ক্যারিয়ারে ১৬০টির অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলেও সুদর্শন অভিনেতা হিসেবে তার আবেদন এখনো অটুট। বতমানে বড় পর্দায় খুব একটা নিয়মিত না থাকলেও চলচ্চিত্রের প্রতি প্রেমটা রয়ে গেছে। ঢাকাই চলচ্চিত্রের নানা বিষয় নিয়ে সম্প্রতি রাইজিংবিডির মুখোমুখি হয়েছিলেন এই চিত্রনায়ক। এ আলাপচারিতার চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—
রাইজিংবিডি : সাফটা চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সিনেমা আমদানি-রপ্তানি করছে। কিন্তু ভারত থেকে যে মানের সিনেমা আমদানি করা হচ্ছে সে মানের সিনেমা ভারতে রপ্তানি করা হচ্ছে না। এ বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আমিন খান : এটা পুরোটাই শুভঙ্করের ফাঁকির মতো ব্যাপার। যদিও এ বিষয়ে বিস্তারিত জানি না। দেশের বাইরে থেকে সিনেমা আমদানির এই নীতি আগেও ছিল। কিন্তু আমাদের দেশ থেকে রপ্তানি করা সিনেমাটি সেই দেশের কোথায় প্রদর্শিত হচ্ছে? আদৌ কি সে দেশের ভালো কোনো জায়গায় সিনেমাটি প্রদর্শিত হচ্ছে? আমার মনে হয়, এ বিষয়টি মনিটরিং করা প্রয়োজন। মনিটরিং হচ্ছে কিনা সেটাও আমি জানি না। যদি মনিটরিংটা ভালোভাবে করা হয় তবে এটা একটি ভালো দিক বলে মনে করি।
রাইজিংবিডি : সিনেমা আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে দেশের কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি স্বার্থে চলচ্চিত্রের ক্ষতি করছে। এ ক্ষেত্রে শিল্পীরা কী কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন?
আমিন খান : আমাদের করণীয় বলতে আমরা দর্শকদের বলতে পারি, আপনারা যদি দেশের সংস্কৃতিকে ভালোবাসেন, দেশের চলচ্চিত্রকে ভালোবাসেন তবে দেশি চলচ্চিত্র বেশি বেশি প্রচার করুন। দেশের ভালো মানের সিনেমাগুলো দেখুন। তাতে পরিচালক-প্রযোজক ভালো মানের সিনেমা নির্মাণে উৎসাহী হবেন। ভালো সিনেমা মানে শুধু ক্ল্যাসিক্যাল ফিল্ম নয়। আমি ভালো সিনেমা বলতে বুঝি— যে সিনেমা সব মানুষ দেখে। এজন্য দেশি সিনেমা আমাদের সবার প্রচার করা উচিৎ। শুধু দর্শক নয়, যারা বিনোদন সাংবাদিক রয়েছেন তাদেরও দেশের ভালো সিনেমাগুলোর প্রচার করা উচিৎ।
ধরুন, আমার একটি ভালো সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু আমার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ভালো না। এজন্য সিনেমাটি নিয়ে আপনি খবর প্রকাশ করলেন না। এটা ঠিক না। কারণ আপনি আপনার পেশার সঙ্গে সুবিচার করলেন না। বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হলে ভালো কাজকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
আমি একটা বিষয় খেয়াল করেছি, আশেপাশের দেশের কিছু সিনেমা মুক্তি পেলে, আমাদের দেশের অনেক বিনোদন সাংবাদিক সিনেমাটির বিস্তারিত বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে থাকেন। অথচ সিনেমা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ওই সাংবাদিকের কোনো যোগাযোগ নেই, তারা কোনো প্রেস রিলিজও পাঠাননি। তারপরও কিন্তু সিনেমাটি নিয়ে সুন্দরভাবে সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। অথচ দেশি সিনেমার সংবাদ প্রকাশ না করে নানা কথা বলে থাকেন। যেমন: একটা খবর দিলেন না। আপনি কোনো যোগাযোগ রাখলেন না ইত্যাদি। আসলে আমাদের সবাইকে মিলে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে চলচ্চিত্রের এই খারাপ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
রাইজিংবিডি : বর্তমানে ইউটিউব, নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখার সুযোগ রয়েছে। নানাভাবে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটছে। এটা কি চলচ্চিত্রের জন্য ইতিবাচক না নেতিবাচক?
আমিন খান : এটা চলচ্চিত্রর জন্য হুমকি তখন হবে যখন এ বিষয়ে আমরা অশিক্ষিত থেকে যাব, প্রযুক্তি সম্পর্কে অন্ধকারে থাকব। ধরুণ, একজন হাতুড়ে ডাক্তার একটি মফস্বল শহরে ২০-৩০ বছর ধরে রোগী দেখছেন। কিন্তু সেখানে যখন উন্নত একটি হাসপাতাল তৈরি হবে তখন ওই ডাক্তারের জন্য এটা হুমকিস্বরূপ। বর্তমানে সময়ে মানুষের বিনোদনের মাধ্যম অনেক আপডেট হয়ে গেছে। চাইলেই আপনি এই মাধ্যমগুলোকে ব্যারিকেট দিয়ে আটকে রাখতে পারবেন না। এজন্য এন্টারটেইনমেন্ট সেক্টরের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজ নিজ জায়গা থেকে সবাইকে শিক্ষিত হতে হবে।
রাইজিংবিডি : একটি চলচ্চিত্র অনেকগুলো বিষয়ের সমষ্টি। যেমন: চিত্রনাট্য, গল্প, ড্যান্স, ফাইট, শিল্প নির্দেশনা, সম্পাদনা, নায়ক-নায়িকা ইত্যাদি। আমাদের ইন্ডাস্ট্রির সংশ্লিষ্টরা কোন বিষয়ে আপডেট না?
আমিন খান : প্রত্যেকটি জায়গায় পিছিয়ে আছে। চলচ্চিত্র নির্মাণ, পারফরম্যান্স, বিক্রয়-বিপণন অর্থাৎ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট যতগুলো সেক্টর আছে তার সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের কেউ আধুনিক সিনেমার জন্য কি লাগে সে বিষয়ে আপডেট না। বলতে পারেন, এটা আমার সহজ-সরল স্বীকারোক্তি। গত ১৫/২০ বছর আগে এ বিষয়ে আমাদের কোনো ইনস্টিটিউশন ছিল না। লেখা-পড়া শিখে তো এই কাজ করতে হবে। এখন দেখে শেখার সময়টা আর নেই। কারণ এতে করে যার কাছ থেকে শিখছি, তারচেয়ে উপরে উঠা সম্ভব না। আবার আমাকে দেখে যে শিখবে সেও আমার উপরে যেতে পারবে না বরং নিচে থাকবে। তার মানে পরবর্তী প্রজন্ম আগাতে পারবে না। এখন কিছু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু ১০ বছর আগে যখন এই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ছিল না তখন অন্তত কিছু মানুষকে পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো উচিত ছিল। তাহলে বর্তমানে যোগ্য মানুষের যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে এটা হতো না। আমাদের এখন ইন্সট্রুমেন্ট আছে, আরো আসছে, কিন্তু এসব ইন্সট্রুমেন্ট কে হ্যান্ডেল করবে? এসব ইন্সট্রুমেন্ট হ্যান্ডেল করার দক্ষ মানুষ নেই। অর্থাৎ যারা এসব ব্যবহার করেন তারা সময়ের সঙ্গে আপডেট হয়নি। আধুনিক স্ক্রিপ্টের যে প্যাটার্ন সে অনুযায়ী আমাদের দেশে চিত্রনাট্যকার তৈরি হয়নি, একদমই তৈরি হয়নি। আজ থেকে ২০/৩০ বছর আগে যে প্যাটার্নে চিত্রনাট্য রচনা করা হতো এখনো ঠিক সেই প্যাটার্নে গল্প, চিত্রনাট্য রচনা করা হচ্ছে। এই গল্প আগে অ্যানালকে শুটিং করতাম এখন ডিজিটাল ক্যামেরায় শুটিং করছি, পরিবর্তন শুধু এইটুকু। সিনেমার মার্কেটিং ঠিক আগের মতোই, এখানেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনো কাকড়াইলের থার্ড পার্টি ব্রোকারের উপর নির্ভরশীল। এ থার্ড পার্টিও আপডেট হয়নি বরং সেই পুরোনো সিস্টেমের মধ্যে রয়ে গেছে।
রাইজিংবিডি : কিছু কিছু পরিচালক দেশের দর্শকের জন্য সিনেমা বানাচ্ছে না…
আমিন খান : এসব পরিচালক গণমানুষের জন্য সিনেমা বানাচ্ছে না। বাংলাদেশের পাশ্ববর্তী দেশ সিনেমা নির্মাণে অনেক ডেভেলপ করেছে, বাংলাদেশের তুলনায় তাদের অনেক বড় মাপের পরিচালক রয়েছে। তারা তো সবাই গণমানুষের জন্য সিনেমা বানাচ্ছে তবে আমাদের নয় কেন? তারা গুটি কয়েক দর্শকের জন্য কেউ সিনেমা বানায় না। তারা গণমানুষের জন্য সিনেমা বানিয়ে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও পাচ্ছে। তাদের বাণিজ্যিক সিনেমাগুলোও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাচ্ছে।
রাইজিংবিডি : আপনার অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘অবুঝ দুটি মন’। ১৯৯৩ সালে এটি মুক্তি পায়। তখনো সিনেমার পোস্টারে আধুনিকতা ছিল।
আমিন খান : সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে সিনেমাটির পোস্টার যথেষ্ট আধুনিক ছিল। তখন প্রযোজক, পরিচালককে দেখেছি সিনেমাটির পোস্টার নিয়ে গবেষণা করতে। রাত-দিন পরিশ্রম করেছেন। একটা পোস্টার ডিজাইন নিয়ে ২০-৩০দিন মিটিং করতে দেখেছি। বর্তমানে এই চর্চাটাও করতে দেখি না।
রাইজিংবিডি : এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী?
আমিন খান : এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার উপায় হচ্ছে সাবসিডিয়ারি দেওয়া। সরকারকে প্রচুর সাবসিডিয়ারি দিতে হবে। যেসব তরুণরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ইনস্টিটিউশন থেকে পাশ করেছে তাদেরকে সিনেমা নির্মাণের দিকে আহ্বান করতে হবে। এই তরুণ মেধাবীদের বের করে আনার জন্য সাবসিডিয়ারি দিতে হবে। তাদেরকে বলতে হবে— গণমানুষের জন্য সিনেমা বানাও। কিছুদিন আগে ‘ছিঁটকিনি’ নামে একটি সিনেমা মুক্তি পায়। এটা সরকারি অনুদানে নির্মিত। এই সিনেমা ঢাকা শহর তো দূরে থাক কোনো বিভাগীয় শহরের একটা সিনেমা হলেও মুক্তি পায়নি। মফস্বল শহরের এক হলে দুই দিন চলে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। এই ধরনের সিনেমা আমরা কেন নির্মাণ করব?
রাইজিংবিডি : তার মানে কী সরকারি অনুদান সঠিক জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে না?
আমিন খান : আমার তো মনে হয় একদম ঠিক জায়গায় ব্যবহার হচ্ছে না। অনুদানের টাকায় সেই সিনেমা নির্মাণ করা উচিত যেটা সারা বাংলাদেশের মানুষ দেখবে। গুটি কয়েক মানুষ সিনেমা দেখল আর বাহবা দিলো। এই গুটি কয়েক মানুষ কোনো দিন পয়সা দিয়ে হলে গিয়ে সিনেমা দেখে নাই। এদের জন্য সিনেমা বানিয়ে আমার কোনো লাভ নাই।
‘ঢাকা’ অ্যাটাক সিনেমাটি আমার পরিবারসহ তিনবার দেখেছি। এই সিনেমা দেখার পর আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, বাংলাদেশের সিনেমার ট্র্যাক বোধহয় পরিবর্তন হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের ফিল্ম এই প্যাটার্নে হওয়া উচিৎ। কিন্তু একজনকে দিয়ে তো ট্র্যাক পরিবর্তন করা যাবে না। এই প্যাটার্নে সিনেমা নির্মাণের জন্য অন্তত দশজন নির্মাতা প্রয়োজন। এই দশজনকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। তারা যেখানে যেখানে শুটিং করতে চায় তাদের সেখানে সেখানে শুটিংয়ের সুযোগ দিতে হবে। কাজটি করার জন্য তারা যেন উৎসাহ বোধ করে। এই ধরণের নির্মাতাদের অনুদান দিতে হবে। যারা মেইন স্ট্রিমের সিনেমা বানাতে পারে।
রাইজিংবিডি : বর্তমানে নায়ক-নায়িকারও সংকট দেখা যাচ্ছে…
আমিন খান : এগুলো কোনো সংকট মনে করি না। যখন সিনেমার বাজার তৈরি হবে তখন এসব সমস্যা থাকবে না। নতুন নতুন অনেক শিল্পী কাজ করতে চলে আসবে। কাজের ক্ষেত্র থাকলে মানুষ অটো চলে আসে। চাহিদাই পণ্য বাড়িয়ে দিবে। যখন চাহিদা বাড়বে তখন দেখবেন প্রচুর শিল্পী চলে আসবে। সিনেমার মার্কেট নাই বলে নতুন শিল্পী আসছে না।
রাইজিংবিডি : নায়কের ক্ষেত্রে আমাদের চলচ্চিত্র ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। এটা কী ঢাকাই চলচ্চিত্রের জন্য ক্ষতিকর?
আমিন খান : অবশ্যই এটা ক্ষতিকর। ধরুণ, আজকে ব্রাজিলের বিপরীতে নেপাল খেলবে। আপনি মাঠে দর্শক পাবেন? এই ম্যাচে হয়তো ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হবে কিন্তু মাঠে আপনি দর্শক পাবেন না। মাঠে এন্টারটেইন করতে গেলে সমানে সমান কম্পিটিশন লাগবে। এজন্য কম্পিটিশন আমাদেরকেই বানিয়ে নিতে হবে। না হলে সিনেমার মার্কেট পড়ে থাকবে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ আগস্ট ২০১৯/শান্ত/ফিরোজ