বিনোদন ডেস্কঢাকা, ১৭ ফেব্রুয়ারি : ২০০৮ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য ছিল ভয়াবহ দিন। দিনটির জন্য কেউ বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলেন না। আগের দিন মধ্যরাত পর্যন্ত যিনি শুটিং করেছেন, সকাল বেলায় তিনি আর নেই। এমন একটি সংবাদের জন্য কেউ কি কখনও অপেক্ষায় থাকে? চলচ্চিত্র শিল্পসহ পুরো দেশবাসীও ছিলেন না। একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই ঘটে গেল ঘটনা। হঠাৎ মান্না চলে গেলেন না ফেরার দেশে। অবিশ্বাস্য এ ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে পুরো জাতি।মান্না’র অকাল ও আকস্মিক মৃত্যুতে থমকে যায় পুরো দেশ। সবারই এক কথা, এমন তো হওয়ার কথা নয়, কেন এমন হলো, এখন কি হবে, ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। আর মান্না-ভক্তদের এফডিসির সামনে ভিড় প্রমাণ করে দেয়, মান্না মান্না-ই। ওই দিন ঘটে অনেক অভাবনীয় ঘটনা। ইউনাইটেড হাসপাতালে হাজারো মানুষের জটলা। এফডিসির প্রধান দুটি সড়কে জনস্রোত। নাগরিক শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেয়ার পরিকল্পনা বাতিল করতে হয় সেখানে লাখ লাখ ভক্তের উপস্থিতির কারণে। মান্নার মরদেহ যাবে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু জনস্রোতের কারণে এফডিসি থেকে মরদেহ বের করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বাত্মক চেষ্টা চোখে পড়ে।মান্নার মৃত্যুর পর এমন অনেক কিছুই হলো। এলো অনেক আশ্বাসও। বিএফডিসিতে ডিজিটাল কালার ল্যাবের নামকরণ করা হলো মান্না ডিজিটাল কমপ্লেক্স । কিন্তু আজ সেই নেমফলকও ভবন থেকে খুলে ফেলা হয়েছে। মান্না ফাউন্ডেশন ও মান্না স্মৃতি সংসদ গঠন করা হলো। যা এখন স্থবির। মান্নার নিজ হাতে গড়া প্রযোজনা সংস্থা কৃতাঞ্জলি চলচ্চিত্র আজ কর্মশূন্য। মান্নার নামে একটি মিউজিয়াম গড়ে তোলার কথা ছিল তার স্ত্রী শেলীর। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। মান্না যেখানে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে আছেন, সেখানকার রাস্তার নামকরণ মান্নার নামে করার আশ্বাস দিয়েছিলেন স্থানীয় পৌর মেয়র। কিন্তু সেটাও বাস্তবায়ন হয়নি।আজ মান্না’র মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার উত্তরার বাসভবনে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে তার পরিবার। কিন্তু বিএফডিসিতে কোন আয়োজন নেই। তারপরও মান্না আছেন, মান্না থাকবেন তার অগনিত ভক্তের মাঝে।আজ চলচ্চিত্রের কোন দুঃসময় এলেই মান্নার কথা উঠে আসে। কোন আন্দোলনে নেতৃত্বের কথা উঠলেও ফুটে ওঠে মান্নার অভাব। কারণ, অশ্লীল ছবির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে মান্নাকে অস্ত্রের সামনে পড়তে হয়েছিল। তারপরও দমানো যায়নি তাকে। চলচ্চিত্রের অশ্লীলতা বন্ধে তার ভূমিকাও ছিল মনে রাখার মতো। আর পর্দার উপস্থিতি তো দর্শকরা কখনও ভুলতে পারবেন না।১৯৬৪ সালে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে জন্ম নেন মান্না। তার আসল নাম এস এম আসলাম তালুকদার]। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পরই ১৯৮৪ সালে তিনি নতুন মুখের সন্ধানে’র মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন।
কাজী হায়াত এর দাঙ্গা ও ত্রাস ছবির কারনে তার একক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সহজ হয়ে যায়। এরপর মোস্তফা আনোয়ার-এর অন্ধ প্রেম, মমতাজুর রহমান আকবর এর প্রেম দিওয়ানা, ডিস্কো ড্যান্সার, কাজী হায়াত এর দেশদ্রোহী, আকবরের বাবার আদেশ ছবিগুলো মান্নার অবস্থান শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।মান্না একমাত্র নায়ক যিনি ১০০ এরও অধিক পরিচালক ও ৬১ জন নায়িকার সঙ্গে ছবিতে অভিনয় করেন। যা যে কোন অভিনেতার জন্য একটি বিরল রেকর্ড। ৯০ দশক আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের একটি স্মরণীয় দশক। এই দশকে পুরনো নায়ক নায়িকাদের পাশে আমরা পেয়েছিলাম অনেক নতুন মুখের অনেক সেরা ছবি যেগুলো বাণিজ্যিক ছবির ব্যবসার তুঙ্গে নিয়ে যায়। সে সময় মান্নার নতুন দেখতে পায় ঢাকাই ছবির দর্শকরা। তিনি একর পর এক অভিনয় করেন অশোক ঘোষ-এর শাদী মোবারক, বুলবুল আহমেদ-এর গরম হাওয়া, কাজী হায়াত এর দাঙ্গা, ত্রাস, সাইফুল আজম কাশেম-এর সাক্ষাৎ, কামাল আহমেদ-এর অবুঝ সন্তান, দেলোয়ার জাহান ঝনটুর গরীবের বন্ধু, (আলমগীর) দিয়ে কাঁপিয়ে দেয়া মান্না ধীরে ধীরে এগুতে থাকেন। ৯১-৯৩ নতুন মুখ নাইম-শাবনাজ ও ৯৩-৯৬ সালমান-শাবনুর, সানী -মৌসুমি জুটির ব্যবসা সফল ও দারুন সব ছবির পাশাপাশি মান্না হাজির হয় মমতাজুর রহমান আকবর এর প্রেম দিওয়ানা, বাবার আদেশ, কাজী হায়াত-এর সিপাহী, দেশপ্রেমিক, দেশদ্রোহী, নুর হোসেন বলাই-এর ওরা তিনজন, শেষ খেলা, নাদিম মাহমুদ-এর আন্দোলন, রুটি, রাজপথের রাজা, এম এ মালেক এর দুর্নীতিবাজ , এফ আই মানিকের বিশাল আক্রমন, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুর চিরঋণী, এ যে রানার মানুষ, বেলাল আহমেদ-এর সাক্ষী প্রমান, মমতাজুর রহমান আকবর এর ডিস্কো ড্যান্সার, বশিরা মতো সুপারহিট ছবি দিয়ে মান্না নিজেকে প্রমান করতে থাকেন আর দিন দিন পরিচালকদের আস্থা অর্জন করেন।
৯৬ তে সালমান শাহ-এর মৃত্যুর পর সালমান-সানী যুদ্ধের অবসান ঘটে। তখন পরিচালকরা একজন আস্থাশীল নায়কের সন্ধান করতে থাকেন যেন তাঁদের ব্যবসা লোকসান না হয়। ঠিক সেই সময়ে মান্না পুরো চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে নিজের কাঁধে তুলে নেয়ার মতো কঠিন দায়িত্ব পালন করেন। ৯৭ সালে নায়ক হয়ে প্রযোজকের খাতায় নাম লিখান মান্না। সেই ছবি পরিচালনার দায়িত্ব দেন কাজী হায়াত কে। যার ফল লুটতরাজ এর মতো একটি সুপার ডুপারহিট ছবি। শুরু হয় মান্নারে একক যুগ। মুক্তি পেতে থাকে এনায়েত করিমের ক্ষুধার জ্বালা, নাদিম মাহমুদ এর এতিমরাজা, কাজী হায়াত এর তেজী, আকবরের শান্ত কেন মাস্তান, ইস্পাহানি আরিফ জাহানের মোস্তফা ভাই , দেলোয়ার জাহান ঝনটুর রাজা বাংলাদেশী, এর মতো বছরের সেরা ব্লকব্লাসটার ছবি। শুরু হয়ে যা চারদিকে মান্না নামের ঝড়।
১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় আকবরের কে আমার বাবা, কাজী হায়াত আম্মাজান, রায়হান মুজিব ও আজিজ আহমেদ বাবুল-এর খবর আছে, মালেক আফসারি পরিচালিত ২য় প্রযোজিত ছবি লাল বাদশা মতো সুপারহিট ছবি।আম্মাজান ছায়াছবির কারনে মান্না সেই বছর বাচসাস এর সেরা নায়ক এর পুরষ্কার পান। ২০০০ এর দিকে যখন বাংলা চলচ্চিত্রের একটু একটু করে আঁধার নামতে থাকে তখন একমাত্র নায়ক মান্নার ছবিগুলো ছিল প্রযোজক ও পরিচালকদের আশার আলো এবং ব্যবসায় টিকে থাকার সাহস। মুক্তি পেতে থাকে কাজী হায়াত এর আব্বাজান। এই ছবির কারনে ২য় বার বাচসাস পুরষ্কার পান তিনি। মালেক আফসারির মরণ কামড়, ছটকু আহমেদ-এর শেষ যুদ্ধ, আকবরের গুন্ডা নাম্বার ওয়ান, কুখ্যাত খুনি, কাজী হায়াত-এর বর্তমান, এফ আই মানিকের সুলতান, বদিউল আলম খোকনের দানব, আকবরের আঘাত পাল্টা আঘাত, মাস্তানের উপর মাস্তান, জীবন এক সংঘর্ষ, এফ আই মানিকের স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ, কাজী হায়াত এর সমাজকে বদলে দাও, দেলোয়ার জাহান ঝনটুর বীরসৈনিক, জিল্লুর রহমান-এর ঈমানদার মাস্তান, ইস্পাহানি আরিফ জাহান এর নায়ক, কাজী হায়াত-এর মিনিস্টার, কষ্ট; মালেক আফসারির বোমা হামলা, শহিদুল ইসলাম খোকনের ভেজা বিড়াল, এফ আই মানিকের দুই বধু এক স্বামী, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুর অশান্ত আগুন, ইস্পাহানি আরিফের ভিলেন, আকবরের আরমান, টপ সম্রাট, শাহাদত হোসেন লিটন-এর কঠিন পুরুষ, বদিউল আলম খোকন এর রুস্তম, এফ আই মানিকের ভাইয়া, বদিউল আলম খোকনের ধংস, বাবার কসম, বাস্তব; শাহিন সুমন এর নেতা, মনোয়ার খোকনের সত্যর বিজয়, শরিফ উদ্দিন খান দিপুর বাঁচাও দেশ, আহমেদ নাসির পরিচালিত মনের সাথে যুদ্ধ এর মতো অসংখ্য সুপারহিট ছবি।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে খারাপ সময়ে এতো বেশী সুপারহিট ব্যবসাসফল ছবি আর কোন নায়কের নেই। ৯৭ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (২০১০ এর ফেব্রুয়ারি) মান্না একাই বাংলা চলচ্চিত্রকে টেনে নিয়ে গেছেন। এই নায়ককে দায়িত্বশীলরা মনে রাখলেও তার দর্শক এখনো তাকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করেন। তিনি দর্শক মনে আছেন নীরবে, নিজের অস্তিত্ব নিয়েই।
রাইজিংবিডি / রাশেদ শাওন