বিনোদন

বিরল মানুষ অভিনেতা মোসলেম উদ্দিন 

শহীদুল জহিরের গল্প অবলম্বনে নির্মিত ছবি 'কাঁটা'তে অভিনয় করেছেন একদল বয়স্ক অভিনেতা যারা সবাই পুরান ঢাকার ভূতের গলির মহল্লাবাসী। করোনা প্যানডেমিকের আগেই এ ছবির  শুটিং শেষ হয়। বর্তমানে পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজ চলছে। ছবিতে নানান বয়সী অভিনেতা থাকলেও বেশি বয়স্কদের একটা প্রাধান্য রয়েছে। অভিনয় করেছেন এস এম মহসীন, কায়েস চৌধুরী, পরেশ আচার্য, সৈয়দ গোলাম সারোয়ার, মৃণাল কান্তি দে, নারিন্দার পঞ্চায়েত প্রধান ও ন্যাপ নেতা শাহাবুদ্দিন, পাবনার মোসলেম উদ্দিনসহ অনেকে।

এর মধ্যে কিছুদিন আগেই করোনার শিকার হয়ে স্বজ্জন অভিনেতা এস এম মহসীন ও নির্মাতা-অভিনেতা কায়েস চৌধুরী প্রয়াত হলেন। কিছুদিনের মধ্যেই ছবিটি মুক্তি পাবে অথচ তাঁরা দেখে যেতে পারলেন না, দুঃখবোধ থেকে যাচ্ছে 'কাঁটা' টিমের জন্যে। এই ছবিতে অভিনয় করেছেন প্রায় দুইশোর অধিক চরিত্র, পর্দায় যাদের ৯৯ ভাগই অপরিচিত মুখ। 

'কাঁটা'র অন্যতম প্রধান একটি চরিত্রের নাম মওলানা আবুবকর। তিনি ১৯৭১ সালে ভূতের গলির শান্তি কমিটির নেতা, মহল্লার রাজাকারদের কুকর্মের নির্দেশ দাতা। ভেবেছি, মওলানা আবুবকরের চরিত্রটা এমন কাউকে দিয়ে করাতে চাই, যাকে রাজাকার দলের নেতা হিসেবে যেন বেশি মেকআপ করাতে না হয়। কথা হচ্ছিল নাহিদ মাসুদের সঙ্গে। নাহিদ সিনেমায় সাউন্ড নিয়ে কাজ করেন এবং অকালপ্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। নাহিদের সাজেশন, ‘মওলানা আবুবকর চরিত্রের জন্যে মোসলেম উদ্দিনকে ভাবতে পারেন।' 

মোসলেম উদ্দিনের অভিনেতা হয়ে ওঠার গল্প তারেক মাসুদের সঙ্গে। ‘মাটির ময়না’ ও ‘রানওয়ে’ ছবিতে তিনি করেছেন। পাবনা থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘কবিতা ফোল্ডার’-এর সম্পাদক কবি ইদ্রিস আলীকে নিয়ে একদিন মোসলেম উদ্দিন ঢাকায় এসে 'কাঁটা' ক্যাম্পে যুক্ত হয়ে গেলেন। ২০১৮ ও ১৯ সালে পাবনা থেকে কয়েক ধাপে এসে তিনি নারিন্দায় 'কাঁটা' টিমের সঙ্গে মিলেমিশে থাকলেন, অভিনয় শেষে পাবনায় ফিরে গেলেন। অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের সঙ্গে অতিবাহিত সময়ের গল্প বললেন। মোসলেম উদ্দিন সহজ মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তো পড়েনই, গভীর রাতে তাহাজ্জুদের নামাজও কামাই করেন না। শুটিংয়ের সময় খুব চুপচাপ থাকেন। তিনি যখন পাবনায়, তখন তাঁকে ফোন দিয়ে ‘কেমন আছেন মোসলেম ভাই?' জিজ্ঞাসা করলেই উত্তর দেন, ‘আবহাওয়া ভালো না!’  ‘তাহলে কি পাবনায় ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে? বন্যা হচ্ছে?’  'না।'  'আবহাওয়া ভালো না মানে কি মোসলেম ভাই? ঠাণ্ডা না গরম?' তিনি বলেন, ‘শরীর ভালো না।’ 

‘কাঁটা’ সিনেমার একটি দৃশ্যে মোসলেম উদ্দিন

আবহাওয়া ভালো না মানে একদিন হয়তো শরীর ভালো না, একদিন হয়তো তাঁর স্ত্রীর শরীর অসুস্থ। আবহাওয়া ভালো না মানে একদিন হয়তো তাঁর মন ভালো না, হয়তো কারও সঙ্গে তাঁর ঝগড়া-টগড়া হয়ে গেছে। ‘মোসলেম ভাই কেমন আছেন?' 'আবহাওয়া ভালো না।'  'কেন?'  তিনি বলেন, ‘কবি ইদ্রিস আলী মারা গেছেন, বয়সে আমার কিছুটা ছোট ইদ্রিস।’ মোসলেম উদ্দিনের গলায় ঝোলানো থাকে একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা। রাস্তাঘাটে তিনি প্রচুর ছবি তোলেন। 

পাবনার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বিরুদ্ধে তিনি সংক্ষুব্ধ। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, ‘১৯৭১ সালে যে রাজাকারকে ধরে আমি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে গেছি, সেই রাজাকারও পরে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাইল, এখন ভাতা পাচ্ছে, আর আমার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় উঠল না! ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু যখন পাবনায় আসেন, আমিও নেতার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছি। আমি এই দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আমি গান ভালোবাসি। আমি ধ্যান ভালোবাসি। জীবনের আনন্দ ভাগ করতে ভালোবাসি। মানুষের হাসিমুখ দেখতে পারাই আমার নেশা।’ 

‘কাঁটা’ ছবিতে রাজাকার দলের নির্দেশ দাতা মওলানা আবুবকর চরিত্রের অভিনেতা মোসলেম উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটাই তো মজা। এটাই মনে করেন আমার প্রতিবাদ।’

পাবনা শহর থেকে দশ কিলো দূরে টেবুনিয়া সিটগোডাউন বাজার। এই বাজারেই মোসলেম উদ্দিনের আস্তানা। আস্তানার সামনে একটি বটবৃক্ষ। মোসলেম সাইয়ের ধ্যানের আসন নির্মাণ হচ্ছে। সিটগোডাউন বাজার থেকে দুই কিলো দূরে বাড়ইপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। সেখানে বউছেলেমেয়ে-নাতনিরা থাকে। আস্তানার দেয়ালে ঝুলছে ক্যালেন্ডার। ক্যালেন্ডারে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের ছবি, নিজ উদ্যোগেই ছাপিয়েছেন। তিনি পাবনাতে করেছেন তারেক মাসুদ স্মৃতি পরিষদ। দেয়ালে তিনি বৃদ্ধ কল্যাণ সমিতির পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। নিজের পরিচয় সম্পর্কে ক্যালেন্ডারে ছাপা আছে, মোসলেম উদ্দিন, অভিনেতা, মুক্তিযোদ্ধা, ফটোসাংবাদিক ও সমাজসেবক। 

হয়তো এতক্ষণে মোসলেম উদ্দিনের আস্তানায় এসে গেছে কোনও তরুণ বাউল। বেজে ওঠে তাঁর একতারা, কণ্ঠে লালন। সেই কণ্ঠে কণ্ঠ মেলান মোসলেম উদ্দিন, নাচেনও এমন ভাবে, মনে হয়, পাবনায় নয়, তিনি আছেন বারামখানায়, ছেউড়িয়াতে, কণ্ঠে তখন, ‘গৌর এসে হৃদে বসে, করল আমার মনচুরি, সে কি আমার কবার কথা, আপন বেগে আপনি মরি…’ 

বিরল ধরনের মানুষ তিনি, স্বতন্ত্র, স্পষ্টভাষী। স্থানীয় বাস্তবতায় এমন মানুষকে বুঝে উঠতে পারা অন্যদের জন্যে সহজ নয় একটুও। ‘কাঁটা’ ছবিতে দর্শক তাঁকে দেখতে পাবেন খুব কঠিন ও নিষ্ঠুর মানুষ হিসেবে, যদিও বাস্তবে তিনি ভীষণ দয়ালু, সাধুগোত্রীয়।