ঢাকাই চলচ্চিত্রের সোনালি সময়ের নির্মাতা দেওয়ান নজরুল। ‘দোস্ত দুশমন’ ‘মাস্তান রাজা’ ‘কালিয়া’ ‘বারুদ’ তার প্রতিটি সিনেমাই ব্যবসা সফল। ১৯৭৬ সালে ‘দোস্ত দুশমন’ সিনেমায় জসিম খল চরিত্রে অভিনয় করে দারুণ খ্যাতি লাভ করেন। অভিনেতা রিয়াজ তার হাত ধরেই চলচ্চিত্রে পা রাখেন। নন্দিত এই নির্মাতার সঙ্গে কথা বলেছেন রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রাহাত সাইফুল।
রাহাত সাইফুল : ৭০-৮০ দশকে ঈদের সিনেমা নিয়ে আপনার ব্যস্ততা কেমন থাকতো?
দেওয়ান নজরুল : ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হতো তখন আমাদের। পাশাপাশি টেনশনও থাকতো দর্শক সিনেমাটিকে রিসিভ করবে কি না এ নিয়ে। তখন আমার সিনেমার প্রিন্ট ৮০-৯০টা করে তৈরি হতো। একসঙ্গে হলে চলতো। সারা বাংলাদেশে আলোড়ন তৈরি হতো। সাংঘাতিক প্রতিযোগিতা ছিল। এ জে মিন্টু, মমতাজ আলী, এস এম শফিসহ অনেক নামকরা বড় পরিচালকের সিনেমা ঈদে মুক্তি পেত। তাদের সিনেমাও অনেক ভালো যেত। প্রতিযোগিতা ছিল তবে নোংড়ামি ছিল না। তখন পরিচালকের নামে সিনেমা চলতো। আমরা আমাদের নাম রক্ষা করার জন্যই ভালো মানের সিনেমা করতাম। খুব করে খেয়াল রাখতাম দর্শক যেন বিমুখ না হয়, পয়সা খরচ করে সিনেমা হলে গিয়ে যেন গালি না দেয়।
রাহাত সাইফুল : এখন সিনেমা হল পেতে অনেক দৌড়ঝাঁপ করতে হয়।
দেওয়ান নজরুল : সিনেমা হল পেতে আমাদের কমপিটিশনে যেতে হতো। হল মালিকগণ সিনেমার দৃশ্য দেখে বুঝতো কোন সিনেমা চলবে। তারা ট্রেইলার দেখতো। এরপর বুকড করতো। তখনও ফিল্ম পলিটিক্স ছিল। তবে ওই যে বললাম নোংড়ামি ছিল না। দৌড়ঝাঁপ ছিল না। হুমকি-ধামকি ছিল না।
রাহাত সাইফুল : সিনেমার প্রচারের ধরন কেমন ছিল?
দেওয়ান নজরুল : প্রচারের ধরন অবশ্যই ভিন্ন ছিল। ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। পত্র-পত্রিকায় প্রচার করা হতো। আমরা প্রচার করতাম রেডিওতে, পত্রিকায়, পোস্টার, ব্যান্ডপার্টির মাধ্যমে। সিনে সাংবাদিকরা সিনেমা নিয়ে লিখতেন। তারা খুব সহযোগিতা করতেন। তখন কোনো তারকা সিনেমার প্রচারে হলো যেত না। নিজের সিনেমা দেখলেও রাতে লুকিয়ে দেখতো। যেন দর্শক টের না পায়। আর এখন শিল্পীরা ঘোষণা দিয়ে সিনেমা হলে যায়। আগে টাকা দিয়ে সিনেমার পর্দায় শিল্পীদের দেখতে হতো। আর এখন বিনে পয়সায় সরাসরি শিল্পী দেখা যায়। তখনকার শিল্পীরা এত সস্তা ছিল না। এসব কারণেই ধীরে ধীরে দর্শক হল বিমুখ হয়েছেন। এখনকার তারকার দাম নেই বলেই হলে গিয়ে সেলফি তোলে। শিল্পীদের আড়ালে থাকতে হতো। শাবানা-ববিতা কখনও হলে গিয়ে দর্শকদের সামনে ধরা দিতো না।
রাহাত সাইফুল : ঈদে সিনেমা মুক্তি দেয়ার জন্য কতটা ব্যস্ত থাকতেন?
দেওয়ান নজরুল : আমাদের সময় তাড়াহুড়ো করে সিনেমার শুটিং করতাম না। এখন তো দেখি ঈদের এক সপ্তাহ আগেও ঈদের সিনেমার শুটিং করে। আমরা একবছর আগেই পরিকল্পনা করে সিনেমা রেডি রাখতাম। তবে এমনটা হয়েছে নেগেটিভ তৈরি করেছি, এর মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে একটা শট শুটিং করে লাগিয়ে দিয়েছি। আমরা সিনেমা করতাম ধরে ধরে।
রাহাত সাইফুল : ‘দোস্ত দুশমন’ বানাবেন। এই ভাবনা কবে থেকে ভাবতে শুরু করলেন?
দেওয়ান নজরুল : আমি ছিলাম ইবনে মিজান সাহেবের সহকারী পরিচালক। ক্যামেরাম্যান অরুণ রায় একদিন আমাকে বলেন- কলকাতায় একটি সিনেমা দেখে এসেছি। তুমি যে ধরনের সিনেমার কথা ভাবছো এটা সেরকম। তবে ওখানকার সিনেমাটি ৩ কোটি রুপির সিনেমা। বাজেট বেশি। এরপরে মাথার মধ্যে ঢুকে যায়। ওখান থেকে কিছু ডায়লগ নিয়ে এসে নিজের মধ্যে নিয়ে সিনেমাটি আমি আমার স্টাইলে নির্মাণ করি। যদিও ওই সিনেমার ছায়া রয়ে যায়। আমার তখন খরচ হয়েচিলে মাত্র ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। প্রায় এককোটি টাকা ব্যবসা করেছিলাম। ওই সিনেমার নাম ছিল ‘সোলে’। খুবই নামকরা সিনেমা। তো পরে সোলের পরিচালক ও টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তখন তারা বলেছিল, তোমার পুরো সিনেমার খরচ দিয়ে আমাদের এক রাতের চায়ের খরচ হয়ে যায়!
রাহাত সাইফুল : বর্তমান সময়ের সিনেমা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
দেওয়ান নজরুল : আমরা তখন সিনেমা নির্মাণ করতাম। কথাটি এ কারণে বলা যে- নাটকও কিন্তু চলচ্চিত্র। তবে এখন অধিকাংশই সিনেমা না। সিনেমার একটা ভাষা আছে। এখন বড় নাটক তৈরি করে সিনেমা হলে চালিয়ে দিয়ে ‘সিনেমা’ বলা হচ্ছে। আসলে এগুলো সিনেমা নয়। আজকে হিন্দি সিনেমা কেন বাংলাদেশে আসছে- এসব সিনেমার কারণে। সিনেমা না চললে হল মালিকগণ চলবে কীভাবে?
রাহাত সাইফুল : সিনেমা নিয়ে আপনার বর্তমান ভাবনা জানতে চাই।
দেওয়ান নজরুল : বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করতে চাই। হাজার বছরের একটি কবিতা। চলচ্চিত্র নিয়ে এটাই আমার শেষ ইচ্ছে বলতে পারেন।