বিনোদন

বাকযুদ্ধ, মিথ্যাচার ও মামলায় চলচ্চিত্রের অসুস্থ সময়: দর্শকের কী দায়

দর্শকদের বিমোহিত করার লক্ষ্যেই সিনেমা নির্মাণ ও অর্থ লগ্নী করেন নির্মাতা-প্রযোজক। তবে বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে, দর্শকদের হলে ফেরাতে সিনেমা সংশ্লিষ্টরা ভালো সিনেমা নির্মাণে যতটা না মনোযোগী, তারচেয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ ও নানা স্ট্যান্টবাজিতেই যেন বেশি ব্যস্ত। অথচ স্ট্যান্টবাজি করে নয়, বরং সিনেমার কোয়ালিটি ভালো হলেই প্রেক্ষাগৃহে ভিড়বে দর্শক।

গত কয়েক বছরে বাকযুদ্ধ, মিথ্যাচার ও মামলায় চলচ্চিত্র অসুস্থ সময় পার করছে। এসবে দর্শকের কী দায়? তারা ভালো সিনেমা দেখবেনই- তবে, দেশের নয় বিদেশের।

সিনেমা সংকটে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা। কিন্তু ঈদ আসলেই সিনেমা মুক্তি নিয়ে শুরু হয়ে যায় কাড়াকাড়ি। মাস খানেক আগেই থেকেই শুরু হয়ে যায় সিনেমা হল পাওয়ার লড়াই। এই লড়াই শুধু সিনেমার কোয়ালিটিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। হল বুকিংয়ের জন্য বুকিং এজেন্টদের সঙ্গে নানা আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতা আর দেনদরবার করার পাশাপশি চলে ক্ষমতার প্রদর্শনও।

এতো গেল সিনেমা মুক্তির আগের চিত্র। মুক্তির পরে শুরু হয় তারকাদের বাকযুদ্ধ। যা নোংরামির চূড়ান্ত পর্যায় রূপ নেয়। বিশেষ করে গত কয়েক বছর ধরে এমন চিত্র দেখা যায়।

এবারের ঈদে সিনেমা মুক্তির পর এরই মধ্যে থানায় দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার ঘটনা ঘটেছে। এবার ঈদুল ফিতরে আটটি সিনেমা মুক্তি পায়। শুরুতে সিনেমা হল পাওয়া নিয়ে কাড়াকাড়ি থাকলেও, পরে দেখা যায় নিজের সিনেমার সুনাম আর অন্যের সিনেমার বদনাম নিয়ে ব্যস্ত চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো হলো- ‘কিল হিম’, ‘লিডার আমিই বাংলাদেশ’, ‘শত্রু’, ‘জ্বীন’, ‘প্রেম প্রীতির বন্ধন’, ‘পাপ’, ‘আদম’ ও ‘লোকাল’। 

মুক্তির পরই অনন্ত জলিল অভিনীত ‘কিল হিম’ সিনেমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়। বলা হয়, গার্মেন্টস কর্মী দিয়ে প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ করা হয়। এমন অভিযোগে মেজাজ হারান এবং গালমন্দ করেন অনন্ত জলিল। অন্যদিকে ‘লিডার আমিই বাংলাদেশ’ সিনেমাটির মেকিং নিয়ে প্রশ্ন তুলেন কেউ কেউ। এছাড়া ‘শত্রু’, ‘জ্বীন’, ‘প্রেম প্রীতির বন্ধন’, ‘পাপ’, ‘আদম’, ‘লোকাল’ সিনেমা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনাও কম নয়।

প্রত্যেক সিনেমার প্রযোজক, নির্মাতা ও শিল্পীদের দাবি, তাদের সিনেমাই সেরা এবং ভালো যাচ্ছে। নিজের ঢোল পেটাতে গিয়ে অন্যদের তুলাধুনা করতেও দেখা যায় তাদের। শুরুটা হয় বাপ্পি ও পরিচালক ইকবালের মধ্যে। বাপ্পির পায়ের নিচে মাটি নেই বলে মন্তব্য করেছিলেন ইকবাল। অন্যদিকে বাপ্পি নিজেকে নারায়ণগঞ্জের ছেলে বলেও হুশিয়ারি করেন। এর পরে পর্যায়ক্রমে এই বাকযুদ্ধে নিজেদের জড়ান জয় চৌধুরী, অনন্ত জলিল, আব্দুল আজিজ, সোলায়মান লেবুসহ অন্যান্যরা। 

এদিকে ‘কিল হিম’ সিনেমার পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল হত্যার হুমকি পাওয়ার অভিযোগ এনে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। অন্যদিকে ‘জ্বীন’ সিনেমা পাইরেসির কবলে অভিযোগ এনে শুক্রবার (২৯ এপ্রিল) সাধারণ ডায়েরি করা হয়।

সিনেমা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের এমন নোংরামি ভালো চোখে দেখছেন না সিনিয়র শিল্পীরা। নব্বইয়ের দশদের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী নায়ক রুবেলের ভাষ্যমতে, ‘এখনকার সিনেমা রিলিজ নিয়ে আর্টিস্টদের যে মনোবৃত্তি দেখছি, তা মোটেও ভালো না। তাদের কথার ধরন খুব ভালো মনে হচ্ছে না। কারো প্রতি কারো সম্মান নেই, শিষ্টাচার নেই। কেন যেন মনে হচ্ছে, আমরা একে অপরের সঙ্গে বুঝি ঝগড়া করার জন্য বা ক্ষতি করার জন্য বাস করি। আসলে এটা উচিত না। আমার কথা হলো- আমরা যা কিছু করি সেটা হবে স্ক্রিনে। এর বাইরে কেন হবে? বাইরে একে অপরের প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। মার্জিত হওয়া উচিত। যেটা কিন্তু আমরা একদমই করছি না।’ 

বর্তমান সময়ের শিল্পী ও নির্মাতাদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘নিজের সিনেমার প্রশংসা করুন। কিন্তু অন্য সিনেমার বদনাম করে নয়। অপরকে ছোট করে নিজেকে বড় করার কিছু নেই। বাইরের লোক যেন আমাদের নিয়ে সমালোচনা করতে না পারে।’

এদিকে নন্দিত নির্মাতা দেওয়ান নজরুলের মতে, ‘আমাদের সময় প্রতিযোগিতা ছিল, তবে নোংরামি ছিল না। তখন পরিচালকের নামে সিনেমা চলতো। আমরা আমাদের নাম রক্ষা করার জন্যই ভালো মানের সিনেমা করতাম। খুব করে খেয়াল রাখতাম দর্শক যেন বিমুখ না হয়, পয়সা খরচ করে সিনেমা হলে গিয়ে যেন গালি না দেয়। সিনেমা হল পেতে আমাদের প্রতিযোগিতায় নামতে হতো। হল মালিকগণ সিনেমার দৃশ্য দেখে বুঝতো কোন সিনেমা চলবে। তারা ট্রেইলার দেখতো। এরপর বুকড করতো। তখনও ফিল্ম পলিটিক্স ছিল। তবে ওই যে বললাম, নোংরামি ছিল না। দৌঁড়ঝাপ ছিল না, হুমকি-ধামকি ছিল না।’

প্রেক্ষাগৃহগুলোতে খবর নিয়ে জানা যায়, মুক্তি পাওয়া আটটি সিনেমার মধ্যে কোনো একটি খুব ভালো যাচ্ছে, তা নয়। সপ্তাহ শেষ না হওয়ার আগেই নেমে যাচ্ছে সিনেমা। একাধিক সিনেমার ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে। গড়পরতায় চলছে ঈদের সিনেমাগুলো। 

এদিকে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের নিজেদের মধ্যে এমন রেষারেষির মধ্যেই শোনা যাচ্ছে, আগামী ৫ মে মুক্তি পেতে যাচ্ছে বলিউড সিনেমা ‘পাঠান’। বিষয়টি দেশীয় চলচ্চিত্রের জন্য ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কেউ কেউ। মুক্তি পাওয়া কোনো সিনেমাই এখন পর্যন্ত লগ্নীকৃত অর্থ ফেরত পায়নি বলে ধারণা করা যাচ্ছে। 

গত কোরবানির ঈদেও ছিল তারকাদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এবারও তাই। যা দেশে প্রেক্ষাগৃহের সংকটকে আবারো সামনে এনেছে। অন্যদিকে এই মারমুখী প্রতিযোগিতাকে পাশে রেখে চলচ্চিত্র বোদ্ধারা মনে করছেন- অন্যের সিনেমার সমালোচনা না করে, নিজের সিনেমাকে কতটা দর্শকদের কাছে পৌঁছানো যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।