ক্যালিগ্রাফিকে বলা হয় জীবন্ত শিল্পকলা। এর সৌন্দর্য, অঙ্কন পদ্ধতি, উপস্থাপনা ও লিপিশৈলীর গভীরতা যেকোনো মানুষকে মোহিত করে। গ্রিক ‘ক্যালোস’ শব্দ থেকে ‘ক্যালিগ্রাফি’ শব্দের উৎপত্তি। এর শাব্দিক অর্থ ‘সুন্দর লেখা’। সুন্দর হস্তলিপিকে ক্যালিগ্রাফি বা চারুলিপি বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এর প্রচলন আছে। যেকোন ভাষায় ক্যালিগ্রাফি হতে পারে। আরবি ক্যালিগ্রাফি অনেক আগ থেকে হয়ে আসছে এবং এটাই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। মুসলিম বিশ্বে ক্যালিগ্রাফি বিশেষভাবে সমাদৃত।
মুনতাসির হক মুন ঢাকা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষার্থী। একেবারে শখের বসে শুরু করা ক্যালিগ্রাফি এখন সম্পূর্ণ পেশা হিসেবে নিয়েছেন এই শিক্ষার্থী৷ তবে বাবা হারানোর পর ছেলে হিসেবে পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধে চলে আসে। মূলত বাবাহীন পরিবারের প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেওয়ার লক্ষ্যেই ক্যালিগ্রাফি বিক্রির মাধ্যমে হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তা। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ক্যালিগ্রাফার হিসেবে নিজের পরিচয় দাঁড় তিনি। নিজের আঁকার প্রতিভাকে রূপ দিচ্ছেন শিল্পে।
মুনের জন্ম কুমিল্লাতে। তবে বেড়ে ওঠা সুনামগঞ্জের ট্যাকের ঘাটে। সেখানেই ছেলেবেলা কাটিয়েছেন তিনি। দুরন্ত এক শৈশব কাটিয়েছেন মুন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া শেষ করে মাদ্রাসায় ভর্তি হন মুন। হয়েছেন হাফেজ। এরপর ৬ বছরের বিরতি। তারপর আবার ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে অধ্যায়নরত।
নিজের নাম আর কাজ মিলিয়ে ২০১৮ সালের মার্চে অনলাইনে মুন ক্যালিগ্রাফি নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন তিনি। আরবি হরফ কিংবা কুরআন ও হাদিসের সুন্দর সুন্দর বাণী, আয়াত বা সূরাসমূহ নিয়ে কাজ করছেন তিনি। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী কখনো কখনো আরবি নামেরও কাজ করেন। আরবি সম্পর্কিত সব ধরনের ক্যালিগ্রাফি নিয়েই কাজ করেন এই তরুণ উদ্যোক্তা।
মুনের সাড়া জাগানো একটি ক্যালিগ্রাফি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুল পরিচিত কার্জন হলের আদলে সূরা ইয়াসিনের দৃষ্টিনন্দন এ ক্যালিগ্রাফিটি। প্রথম দেখাতেই যে কেউ মনে করবে ঢাকার কার্জন হল। শিল্পী মুনতাসীর হক কার্জন হলের আদলেই সুরা ইয়াসিনের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। ৮৩ আয়াত সমৃদ্ধ পুরো সুরাটিসহ আল্লাহর গুণবাচক ২০-২২টি নাম দিয়ে এ ক্যালিগ্রাফিটি সাজিয়েছেন। তিনি ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে যে কেবল ব্যবসা করছেন তা নয়। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশও নিয়েছে। ২০২১ সালে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের সম্মাননা পেয়েছিলেন তিনি। সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন জাতীয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েও।
মুনতাসির হক মুন বলেন, গত ৪ বছর ধরে কাজ করে বুঝেছি- ক্রেতা সুন্দর কিছু চায় তার মনের মতো। যেটা তার মনের ক্যানভাসকে জাগিয়ে তুলবে। তাছাড়া আরেকটা বিষয় হচ্ছে বিশ্বস্ততা। এটা অন্যতম একটা জিনিস যা অত্যন্ত আবশ্যকীয়। এই বিশ্বস্ত শব্দটা আপনার কিংবা আপনার কাজ- উভয়ের প্রতি এই মনসংযোগ থাকলে ক্রেতা কখনো পিছু ছাড়েন না। আমি নিজের পণ্য নিজেই ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি। ঢাকার ভেতরে তিনিই ডেলিভারি ম্যান। তাই অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমে নানা অনুভূতি।
মুনের এই ক্যালিগ্রাফি জীবনের পথ চলাটা শুরুর দিকে পুরোপুরি মসৃণ ছিল না মুনের। পাননি পরিবারের সমর্থন। সবাই বকাঝকা করতেন। বাধা দেওয়া হতো কাজে। কাজের ছবি তোলার জন্য প্রয়োজন একটি ভালো ক্যামেরার ফোন। সেটিও ছিল না তার। তবে বর্তমানে সবাই উৎসাহ দেন তাকে।
নতুন করে যারা ক্যালিগ্রাফিতে আসতে চায় তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমার পরামর্শ থাকবে কাজের পিছনে পরিশ্রম ও সময় দেওয়া। কেননা কষ্ট করলে কেষ্ট মিলে। সততা বজায় রাখতে হবে। বিশ্বাস তৈরি করতে হবে। নিজের কাজের প্রতি বিশ্বাস রাখলে আর নতুনত্ব আনার চেষ্টা করলে অনেকদূর আগানো সম্ভব।’
যান্ত্রিক এই যুগে নিপুন হাতের ছোঁয়াতে মুনতাসীর হক মুনের এই ক্যালিগ্রাফি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে একদিন তুলে ধরবে এমনটাই প্রত্যাশা সবার।