উদ্যোক্তা/ই-কমার্স

দেশের মণিপুরি ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে চান রেহমুমা

বাংলাদেশের মণিপুরি বললেই বিশেষ সংস্কৃতির অধিকারী এক মানবগোষ্ঠীর চিত্র ফুটে উঠে। যাদের বেশিরভাগের বসবাস সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ,হবিগঞ্জ জেলাগুলোতে। তবে ঢাকার তেজগাঁও অঞ্চলেও অনেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এ নৃগোষ্ঠীর তাঁত শিল্পের ইতিহাস ৩০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাদের তাঁতে বোনা পর্দা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

তাদের নানা পণ্যের মধ্যে শাড়ির জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। পর্যটকরা শখ করে দু’একটা কিনে আনতে ভোলেন না। কোভিডের সময় তাঁতিদের অবস্থা চরম শোচনীয় হয়ে পড়ে। ওই সময় কিছু উদ্যোক্তা অনলাইনে মণিপুরি শাড়ির ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালান। এতেই ভাগ্য খুলে যায় মণিপুরি তাঁতিদের।

এসব উদ্যোক্তাদেরই একজন রেহমুমা হোসেন রিংকি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে এমফিল করছেন মণিপুরি হ্যান্ডলুম নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে “রিংকি’স অ্যাটাইয়ার (রিফ্লেকশন অব বাংলাদেশ মণিপুরি লুম)” নামে একটি পেজ রয়েছে। যা মণিপুরি পণ্যের প্রচার ও বিপণনের অন্যতম বড় মাধ্যম কাজ করছে।

রাজধানীর রামপুরা এলাকায় স্বামী ও দুই কন্যা নিয়ে তার সংসার। পেশায় একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা। ২০১৩ সালে শিক্ষিকা হিসেবে পেশা শুরু করলেও উদ্যোক্তা হিসেবে পুরোদমে পথচলা শুরু করেন ২০২০ সালে।রেহমুমা হোসেন বলেন, কোভিডের সময় সবকিছু বন্ধ ছিল, আমরা ঘরবন্দি ছিলাম। ওই সময় চিন্তা করলাম, ঘরে বসে ফেসবুকে সময় নষ্ট না করে সেটাকে কিভাবে কাজে ব্যবহার করা যায়। তো এভাবেই ফেসবুকের মাধ্যমে আমার উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা শুরু হয়।

তবে অনলাইনে কাজ করা নিয়ে তার তেমন কোনো ধারণা ছিল না। তিনি বলেন, আমি অনলাইনে মণিপুরি শাড়িসহ এ সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পণ্যের প্রচার ও বিপণন নিয়ে কাজ করছি। পণ্যগুলো জনপ্রিয়তায় রাত-দিন এক করে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। এটা সম্পর্কে আসলে আমার শূন্য জ্ঞান ছিল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছি।

মণিপুরি শাড়ি বিখ্যাত হলেও রিংকি শাড়ির পাশাপাশি হ্যান্ডলুম ওড়না, শাল, মাফলার, গামছা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছেন। এছাড়াও মণিপুরি রিসাইকেল এবং ডাইভারসিফাইড পণ্য তৈরি করছেন। এর মধ্যে রয়েছে- ব্যাগ, জুতা, কানের দুল, চুড়ি, ওয়ালফ্রেম, বড়দের ড্রেস, বেবি ড্রেস ইত্যাদি।

এই নারী উদ্যোক্তাকে শুরুতে অনেকেই নিরুৎসাহিত করেছেন। বলেছেন- এই ‘ত্যানা শাড়ি’ নিয়ে কাজ করে কি লাভ? তবে তিনি হতাশাবাদীদের দলে নন।

এ উদ্যোক্তা বলেন, আমার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প কোভিডের সময় থেকে। মণিপুরি শাড়ির প্রতি আমার ভীষণ রকমের ভালোবাসা ছিল। তাদের হাতে বোনা শাড়িগুলো আমাকে মুগ্ধ করত। এতো নিখুঁত তাদের কাজ, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। প্রতিটা শাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে, তাঁতির ভালোবাসার ছোঁয়া; সন্তান পালনের মতো। তাদের অনেকে নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও অনেকেই বিশেষ করে মণিপুরি নতুন প্রজন্ম এই পেশা ছেড়েছেন।

তিনি বলেন, আমি আশাবাদী। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসী এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। আমি লাভের কথা চিন্তা করিনি। চেয়েছি ৩০০ বছরের ঐতিহ্য যেন হারিয়ে না যায়।

ছোট-বড় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে রেহমুমার মণিপুরি সম্প্রদায়ের পণ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। পরিবারের বড় রকমের সমর্থন থাকায় প্রতিবন্ধকতা তাকে হতাশ করে না। তিনি অবশ্য মনে করেন, কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলে কোনোকিছুই বাধা হতে পারে না।

রেহমুমার পুরো কাজ অনলাইন ভিত্তিক। সঙ্গে থাকা তিনজন কর্মী সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকার মণিপুরি তাঁতিদের কাছ থেকে সরাসরি পণ্য সংগ্রহ করেন। সেগুলো আবার কাস্টমাইজ করে গ্রাহকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য আছেন আরও দুজন কর্মী। 

তিনি বলেন, আমার কিছু ভেন্ডর  আছে। যারা তাঁতিদের বাড়ি গিয়ে শাড়ি সংগ্রহ করেন। কখনো আমি কালার কম্বিনেশন বলে শাড়ি তৈরি করে নিই। অনেক ক্ষেত্রে শাড়িতে তাঁতির ডিজাইনই থাকে, আমি সেখানে বাইনের সুতার কালার মাঝে মধ্যে পরিবর্তন করি। এ ফিউশন ডিজাইনগুলো সবই আমি করি। বর্তমানে আমাদের দেশের আইকন ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল আপার কাছে ফ্যাশন ডিজাইনের উপর কাজ করছি। আপার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সব কাজ শিখছি।

মণিপুরি হ্যান্ডলুমের কাজ সময় সাপেক্ষ। হুট করে কেউ চাইলেই তিনি সেটা প্রস্তুত করে দিতে পারেন না। তারপরও তিনি প্রতি মাসে দেড় থেকে ২ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেন। তবে তিনি খুব একটা লভ্যাংশ রাখেন না। তিনি চান সঠিক প্রচার-প্রচারণার অভাবে বিলুপ্ত হতে বসা মণিপুরি তাঁত হাজার বছর টিকে থাক।

তার ভাষায়, ২০২০ সালে মণিপুরি তাঁতিরা শাড়ি নিয়ে রাস্তায় বসে থাকতো, বিক্রি হতো না। এখন আর সে অবস্থা নেই, সময় বদলেছে। মণিপুরি শাড়ির জনপ্রিয়তা এখন ঈর্ষণীয়। দেশ ছেড়ে বিদেশে প্রবাসী বাঙালিরা দেশীয় মণিপুরি পণ্য ব্যবহার করছেন। শুধু জ্যামিতিক প্যাটার্ন নয়, ডিজাইনে এসেছে নতুনত্ব।

এ নারী উদ্যোক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগে মণিপুরি শাড়ির প্রচারে গবেষণা শুরু করেছেন। এছাড়া মণিপুরি শাড়ির জিআই ডকুমেন্টেশনে বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের সঙ্গেও কাজ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে আয়োজন করেছেন এ সংক্রান্ত নানা ধরনের সেমিনারের।

মণিপুরি শাড়ির সঙ্গে মণিপুরি রিসাইকেল ও ডাইভারসিফাইড পণ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে শুরুতে মূলধন ছিল ১০ হাজার টাকা। এখন সব মিলিয়ে তার প্রায় ৫০ লাখ টাকা মূলধন আছে।

তিনি বলেন, কখনো ঋণ নিইনি বা প্রয়োজন হয়নি। তবে সামনে বড় পরিসরে কিছু করার প্লান আছে। সেটা সম্ভব হলে ঋণ নিতেও পারি। সরকার ৫% সুদে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের সুযোগ তৈরি করেছেন। সুবিধামতো এটা কাজে লাগাতে পারি হয়তো।

রেহমুমার এ সফলতা পিছনে বড় ভূমিকা অনলাইন মাধ্যমের। তিনি বলেন, আমার উদ্যোগ যতটুকু পরিচিতি পেয়েছে, তার ৯৫% সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য সম্ভব হয়েছে। শুরু করেছিলাম একদম না জেনেবুঝে। কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। কাজ করতে করতে শিখেছি। তবে এখন সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা ধরনের  প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। যদি কেউ এ প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করেন, তবে সেটা অনেক ভালো হবে।

তৈরি পণ্য নিয়ে কাজ করে যেতে চান এবং পুরো বিশ্বকে দেখাতে চান, মণিপুরি পণ্য আমাদের ঐতিহ্য, বাংলাদেশের ঐতিহ্য। ইতোমধ্যে, কলকাতার স্বনামধন্য একজন ফ্যাশন ডিজাইনার তার থেকে মণিপুরি শাড়ি, ব্যাগ নিয়ে একটি শো করেছেন। যা দেশের জন্য গর্বের; সম্মানের।