শায়লা পারভীন। ইডেন মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক ও শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন। ব্যাংকার স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর উত্তরাতে বসবাস করছেন। সংসার সামলানোর পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিন চাকরিও করেছেন। সেটা ছেড়ে এখন তিনি পরোদস্তুর উদ্যোক্তা। এই উদ্যোক্তা হিসেবে পথচলা শুরু হয় গত ২০১৪ সাল থেকে।
তিনি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্যগুলো নিয়ে কাজ করছেন। এর মধ্যে শতরঞ্জি, মসলিন, টাঙ্গাইলের তাঁত অন্যতম। শুরুতে তিনি উই থেকে উদ্যোক্তাদের জন্য মাস্টারক্লাস এবং সফটস্কিল প্রোগ্রামের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর আইসিটি মিনিস্ট্রির সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ক ও ডব্লিউইএসআই’সহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বর্তমানে হ্যান্ডপেইন্টিং এর উপর তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন।
শুরুর গল্প জানাতে গিয়ে এ নারী উদ্যোক্তা বলেন, আমি দীর্ঘদিন চাকরি করেছি। এখানে আসলে নিজের ক্রিয়েটিভিটি দেখানোর সুযোগ কম। আর একটা বিষয় বেশি মাথায় কাজ করেছে, সেটা হলো নিজের ইচ্ছেমতো সময় নিয়ে কাজ সম্পন্ন করার বিষয়টি; যা চাকরি করলে সম্ভব হয় না। প্রথমে আমি উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্টের (উই) প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা আপুর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আমি মূলত শতরঞ্জি, শতরঞ্জি ও লেদারের কম্বিনেশনে ব্যাগ, কুশন কাভার, পিলো কাভার, মসলিন, টাঙ্গাইলের তাঁত নিয়ে কাজ করি। ২০২০ সালে ট্রেড লাইসেন্স নিই।
তবে অনেকের মতো শায়লা পারভীনের সাংসারিক জীবন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। তিনি মনে করেন, সংসার ও কাজ সাংঘর্ষিক না; বরং একে অন্যের পরিপুরক। কারণ স্বামী, সংসার, সন্তান তথা জীবনের জন্যই চাকরি বা উদ্যোগ। একজন নারী উদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা পণ্যের সঠিক উৎস খুঁজে বের করা।
তার পণ্যগুলোর মধ্যে কিছু রাজশাহী, টাঙ্গাইল, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ থেকে সংগ্রহ করেন। আবার কিছু নিজেই তৈরি করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি এসব জায়গা থেকে প্লেন শাড়ি বা কাপড় সংগ্রহ করে কাস্টমাইজ করেন।
তিনি বলেন, তাঁতের শাড়িতে আমার নিজের কোনো কনট্রিবিউশন নেই। এগুলো সরাসরি সংগ্রহ করে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেই। কারণ কন্ট্রিবিউশনের জন্য ভালো রকম বিনিয়োগ প্রয়োজন, যা আমার মতো উদ্যোক্তার জন্য কষ্টসাধ্য।
পণ্যগুলো প্রস্তুত করার জন্য বেশ কয়েকজন রয়েছে। শায়লা বলেন, ব্যাগ সেক্টরে কাজ করার জন্য আমার চারজন সহযোগী আছেন। পোশাকের কাজ সব আমিই করি। আর হ্যান্ডপেইন্টগুলো দক্ষ পেইন্টার দিয়ে করিয়ে নেই।
শায়লা আরও বলেন, শতরঞ্জির ডিজাইনের ক্ষেত্রে কিছু আমার পছন্দমতো থাকে। আবার কিছু ক্রেতারাও দেন। আর গতানুগতিক কিছু ডিজাইন আছে, যা তাঁতিরা যুগ যুগ ধরে করে আসছে।
তার করা ডিজাইনগুলো সম্পন্ন করতে বেশ সময় লাগে। এ ডিজাইনগুলো সম্পন্ন করতে পারিপার্শ্বিক অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। সাতদিন থেকে শুরু করে একমাস পর্যন্ত সময় লেগে যায় কখনো কখনো। এ সময় সাপেক্ষ কাজ তিনি ভালোবাসা থেকেই করেন। এ নারী উদ্যোক্তা মনে করেন, কাজ করার সঙ্গে নিজের ভালোলাগার ব্যাপার জড়িত। ভালো না লাগলে, মেন্টাল সেটিসফেকশন না থাকলে সে কাজ নিয়ে বেশিদুর যাওয়া যায় না।
শায়লার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘ট্র্যাডিশনাল ইন্সিগ্নিয়া’ নামে একটি পেজ রয়েছে। এর মাধ্যমেই তিনি মূলত তার উদ্যোগের কাজগুলো করে থাকেন। এখান থেকে সবমিলিয়ে প্রতি মাসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়।
তিনি বলেন, একজন অনলাইন উদ্যোক্তার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। কারণ প্রচারণা, ক্রেতাসহ উদ্যোগের প্রায় সবকিছুই এখান থেকে পাওয়া যায়।
এ নারী উদ্যোক্তা মনে করেন, একজন উদ্যোক্তার জন্য প্রশিক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, কোনো কাজ না শিখে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যায় না। প্রতিযোগিতার বাজারে সময়ের সঙ্গে তালমিলিয়ে ব্যবসা করা ও নিজেকে আপডেট করার জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত থাকা উচিত।
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, উদ্যোক্তা হওয়ার আগে প্রথমত স্বপ্নবাজ হতে হবে। শুধু স্বপ্ন দেখলেই হবে না, সেটা লালন করে পর্যাপ্ত শ্রম দিতে হবে। আর প্রচুর ধৈর্যশীল হতে হবে এবং পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে হবে। তবে অবশ্যই প্রতিনিয়ত জ্ঞানের চর্চা করতে হবে। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’- এমন ভেবে হতাশ হলে চলবে না।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানাতে গিয়ে এ স্বপ্নবাজ নারী বলেন, আমি নিজেকে এখনো এতোটা সফল ভাবি না। বর্তমানে শতরঞ্জির ডাইভার্সিফাই প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করছি। এটাকে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে চাই, যা একটু হলেও সমাজের মানুষের উপকারে আসবে।