ই-কমার্স নিয়ে আমরা বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ব্যখ্যা দিয়ে থাকি। কিন্তু পূর্ব ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, আমাদের দেশে ২০১৪ সালের আগে ই-কমার্স নিয়ে উদ্যোক্তাদের মধ্যে তেমন ধারণা ছিল না। দেখতাম কিছু সংখ্যক মানুষ ফেসবুক লাইভে এসে বিভিন্ন রকমের দেশী ও বিদেশি পণ্য বিক্রি করতো।
এ দেশের বাজার ব্যবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায়, ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী আমরা পণ্য উৎপাদন করি বা আমদানি করি। সেসব পণ্য পাইকারি থেকে শুরু করে খুচরা হিসেবে আমাদের শহর ও গ্রামের বাজারগুলোতে বিক্রি হয়। তারপরও দেখা যায়, আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ বিশেষ পণ্য উৎপাদিত হয়। কিন্তু এ সম্পর্কে শুধু কিছু পাইকারি ব্যবসায়ী ছাড়া তেমন কেউ চেনে না বা সরাসরি ভোক্তারা বেশি কিছু জানে না পণ্যটির উৎপাদনস্থল সম্পর্কে।
আমাদের ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ই-কমার্সের মাধ্যমে একটি উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করার জন্য সরাসরি বিভিন্ন বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছে দেয় এবং সেখান থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা নিয়ে সরাসরি ভোক্তার কাছে বিক্রি করে।
সহজ কথায় ই-কমার্স বলতে আমি বুঝি, একজন পাঠক সরাসরি হকারের কাছে থেকে পত্রিকা না কিনে ফেসবুকে নিউজ পোর্টাল থেকে পড়তে পারে। একজন ভোক্তা সরাসরি যেকোনো পণ্য অনলাইনের যেকোনো মাধ্যম থেকে তথ্য নিয়ে কিনতে পারে। সেটা হোক ফেসবুক, ইউটিউব, ওয়েবসাইট বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
আমি কখনও ই-কমার্স ও ফেসবুক ভিওিক এফ কমার্স উদ্যোক্তাদের মধ্যে তেমন একটা বৈষম্য তৈরি করি না বা তেমন কোনো বৈষম্য দেখি না। একজন উদ্যোক্তা যদি সরাসরি তার ফেসবুক প্রোফাইলে পণ্যের প্রচার করে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে পারে, সেটাও ই-কমার্সের বাহিরে না।
যদিও বর্তমানে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) মেম্বার হতে গেলে তাদের একটি প্রধান শর্ত হলো- ওয়েবসাইট থাকতে হবে।
এখন একজন উদ্যোক্তা যদি ছোট পরিসরে ই-কমার্স শুরু করেন, সেক্ষেত্রে ব্যয় ও সময়ের সঙ্কটে তার ওয়েবসাইট নাও থাকতে পারে। তাই বলে ই-কমার্সের বাহিরের ফেলে দেওয়ার সুযোগ নেই।
বর্তমানে ই-কমার্সের সঙ্গে ডিজিটাল মার্কেটিং যোগ হয়েছে। তাই আমরা ই-কমার্স ও ডিজিটাল মার্কেটিং এ দুটিকে নিয়ে ই-কমার্সের প্রার্থক্য তৈরি করি।
ডিজিটাল মার্কেটিং এর টুলস ব্যবহার করে আমরা আমাদের ই-কমার্স ভোক্তার কাছে বিভিন্ন উপায়ে প্রচার করার জন্য কোয়ালিটি কন্টেন্ট দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া এবং এসইও ব্যবহার করতে পারি। এখন আমি ফেসবুক ব্যবহার করে পণ্যের প্রচার করার কারণে ই-কমার্স থেকে এফ কমার্স হয়ে গেলাম, বিষয়টা সেটা নয়। এখানে বিষয় হলো আমি আমার ব্যবসাকে প্রচারের জন্য ডিজিটাল মার্কেটিং এর স্ট্র্যাটেজি হিসাবে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক ব্যবহার করতেই পারি। তাই যদি আরও সহজ করে বলি, সেটা হলো আমরা যাকে এফ কমার্স বলি, সেটা ই-কমার্সের একটি ডিজিটাল মার্কেটিং এর অংশ ছাড়া কিছুই না।
দেশে বহুল প্রচারিত বড় একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে আমরা দারাজকে চিনি। কিন্তু দারাজের বেশিরভাগ প্রচার-প্রচারণা কিন্তু আমরা ফেসবুক থেকেই পেয়ে থাকি। আমি একজন ছোট উদ্যোক্তা হিসেবে ফেসবুক ব্যবহার করি, আবার দারাজও ফেসবুক ব্যবহার করে। এজন্য বলবো, এখানে ই-কমার্সে কোনো প্রার্থক্য নেই, প্রার্থক্য হলো- ছোট আর বড়তে।
ই-ক্যাবের সাবেক সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা রাজিব আহমেদ বলেন, ‘ই-কমার্স মানে ইলেকট্রনিক কমার্স। আর ফেইসবুক নিজেও একটা অনেক বড় ধরনের ওয়েবসাইট, যেখানে কোটি কোটি প্রোফাইল বা আইডি, পেজ, গ্রুপ ইত্যাদি আছে। ই-কমার্সের একটা অংশই হলো এফ কমার্স বা ফেইসবুক ভিত্তিক কমার্স। দেশে ওয়েবসাইট ভিত্তিক ই-কমার্স উদ্যোক্তা যত আছেন, তার থেকে অনেক বেশি ফেইসবুক ভিত্তিক ই-কমার্স উদ্যোক্তা আছেন। এর একটাই কারণ ফেইসবুকে একটা পেইজ খুলে বিজনেস করতে একদিকে যেমন কোনো টাকা লাগে না, অন্যদিকে তেমন টেকনিক্যাল নলেজও লাগে না। একটা ওয়েবসাইট করে ই-কমার্স বিজনেস শুরু করতে অন্তত এক লাখ টাকার মত লাগে, ফেইসবুকে সেই খরচ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘দারাজের মত বড় বড় মার্কেট প্লেসে মার্চেন্ট হয়ে বিজনেস করতে গেলে টেকনিক্যাল নলেজ লাগে না বা এমনকি ওয়েবসাইট বানানোর খরচও লাগে না। কিন্তু একজন মার্চেন্ট যা সেল করবেন, তার ১০ থেকে ২০ শতাংশ টাকা কমিশন হিসেবে কেটে রাখে এসব মার্কেট প্লেসগুলো।’
ফেইসবুকভিত্তিক ব্যবসা এ দেশে জনপ্রিয় হওয়ার কারণ জানাতে গিয়ে রাজিব আহমেদ বলেন, ‘এখানে ব্যবসা জনপ্রিয় হওয়ার বড় কারণ হলো, বাংলাদেশে ৫-৭ কোটি লোকের ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। এতো লোক একসঙ্গে এদেশে আর কোন ওয়েবসাইটে নেই। তাই ফেইসবুক প্রোফাইলে, গ্রুপে পোস্ট করে সেল আসা সম্ভব এবং আসছে কোন টাকা খরচ না করে। এটা ওয়েবসাইট খুলে সম্ভব না। ওয়েবসাইটে ভিজিটর আনার জন্য ডিজিটাল মার্কেটিং করতে হয় এবং এজন্য যে খরচ হয়, তা অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পক্ষে সম্ভব না।’
লেখক: দেশীয় ই-কমার্স উদ্যোক্তা ও ‘বাকল’ এর স্বত্বাধিকারী