উদ্যোক্তাদের অনেকেই মনে করেন রাজধানী ঢাকায় না থাকলে উদ্যোগ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এমন ধারণাকে একেবারেই পাল্টে দিয়েছেন নাঈমা চৌধুরী সীমা। তিনি রাজশাহী সিল্ক ও জামদানি শাড়ি নিয়ে কাজ করছেন।
২০০৫ সালে ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর রাজশাহী শহরের নামকরা কম্পিউটার ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে হয় সীমার। এরপর হয়ে যান পরোদস্তুর সংসারী। উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি খুবই সংসারী একটা মেয়ে। তবে ছোট থেকেই একটা স্বপ্ন লালন করতাম, নিজে কিছু করবো। কিন্তু শুরুতে পরিবারের সাপোর্ট পাইনি। বিয়ের পরেও চেষ্টা করেছি কিছু করবো। কিন্তু বাধার সম্মুখীন হয়েছি। আমার বর কখনোই চায়নি, আমি কিছু করি। দুই ছেলে-মেয়ের স্কুল, প্রাইভেট নিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকতে হতো। তাদের পর্যাপ্ত সময় দিতে গিয়ে একসময় অন্যকিছু করার আশাও অনেকটা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
তিনি আরও বলেন, একদিন কাউকে কিছু না বলে নিজে থেকে একটা পেইজ খুললাম। অনেকদিন পর বরকে বললে সে জানতে চাইলো, আমি কি নিয়ে কাজ করতে চাই। তখন ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করবো বলে জানিয়েছিলাম। কিন্তু এর কিছুদিন পরই করোনা শুরু হয়। লকডাউনে ল্যাপটপের স্টক কমতে শুরু করায় সেটা নিয়ে আর কাজ করা হয়নি। তখন কিছু জামদানি শাড়ি কিনে এনে পেইজে ছবি দিতে থাকলাম এবং সাড়াও পেলাম। এভাবেই শুরু হয় আমার ব্যবসা।
এরই মধ্যে এক বান্ধবীর মাধ্যমে ‘উই’ (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স) গ্রুপের বিষয়ে জানতে পেরে সেখানে যুক্ত হন নাঈমা। এ গ্রুপটির মাধ্যমে তিনি মানসিক শক্তি ও পুরো আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। একটা সময় পর পরিবার থেকেও সবাই বেশ সহযোগিতা করতে থাকে।
এরপর তিনি উই, ওয়েব, এসএমই, বিসিক, আইসিটি মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধীনে অসংখ্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
পণ্য প্রস্তুত সম্পর্কে জানতে চাইলে এ নারী উদ্যোক্তা বলেন, রাজশাহীতে তাঁত তৈরি করার সুযোগ নেই। নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জে একটা খুবই গরিব পরিবার আমার পণ্যগুলো তৈরি করে দেয়। করোনার সময় ওরা অভাবের কারণে তাঁত চালাতে পারতো না। আমি তাদের টাকা দিয়ে তাঁত পরিচালনার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছি। আমার পছন্দ ও ক্রেতাদের চাহিদা মতো ডিজাইন পাঠিয়ে দেই। তারা সে অনুযায়ি পণ্যগুলো তৈরি করে দেয়। এর বাহিরে আরও কিছু তাঁতি আছে, যাদের কাছ থেকেও আমি পণ্য নিই।
তবে নাঈমা প্রথমে জামদানি দিয়ে উদ্যোগ শুরু করেন। এর বেশ কিছুদিন পরে সিল্ক নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, প্রথমে পরিবার থেকে খুব বাঁধা আসছিল। পরবর্তীতে সেটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। যারা সবচেয়ে বিরোধিতা করেছিল, তারাই পরে সবচেয়ে বেশি সমর্থন করা শুরু করে। কিন্তু পরিবারিক সহযোগিতা ও সমর্থন পেলেও নতুন করে সমস্যা দেখা দেয়। সেটা হলো- নারায়ণগঞ্জ থেকে শাড়ি তৈরি করে নিয়ে এসে ব্যবসা ঠিকমতো চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এজন্য জামদানির পাশাপাশি রাজশাহীর রেশম সূতা দিয়ে তৈরি সিল্ক পণ্য নিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম।
তার পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে জামদানি ও সিল্কের শাড়ি, থ্রি-পিচ, ওড়না, গাউন পিস, পাঞ্জাবি পিস ইত্যাদি। অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইনেও তার অনেক ক্রেতা রয়েছে। এছাড়া হাইকমিশনের মাধ্যমে তার বিভিন্ন পণ্য বিশেষ করে সিল্কের পণ্যগুলো ব্রুনাই, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে যায়। তিনি নিয়মিত বিভিন্ন মেলায়ও পণ্য নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। সবমিলিয়ে প্রতি মাসে প্রায় ৬০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেন তিনি।
নাঈমা চৌধুরী সীমা ২০২৩ সালে আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে স্মার্ট নারী উদ্যোক্তা হিসেবে অনুদান পেয়েছেন। তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত একজন উদ্যোক্তাও বটে।
উদ্যোক্তা হতে চাইলে কি করা উচিৎ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিটি মেয়েরই কাজ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে তাদের খুব ভালো করে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। যে যেই কাজে পারদর্শী, সেটা নিয়ে শুরু করতে হবে। সবার জীবনে সহজে সফলতা ধরা দেয় না, এখানে যুদ্ধ করে টিকে থাকার পুরো মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। এছাড়া অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেতে হবে। এরপর সঠিক পরিকল্পনা, ধৈর্য্য, আত্মবিশ্বাস, কিছুটা মূলধন নিয়ে নেমে পড়তে হবে। এগুলো না থাকলে মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি। আর কারো নকল না করে নিজ যোগ্যতায় কাজ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি খুবই সংসারি একটা মেয়ে। আমি ছেলে-মেয়ে ও সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকি। এর বাহিরে যতটুকু সময় পায়, সেটা দিয়ে আমার উদ্যোগ পরিচালনা করি। তবে ভবিষ্যতে রাজশাহী রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সিল্ক নিয়ে একটা বড় আউটলেট দেওয়ার ইচ্ছে আছে। রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সিল্ক একেবারেই অরজিনাল। আমার এটা নিয়ে কাজ করার খুব ইচ্ছে।
এখনই শুরু না করার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, রাজশাহীতে উষা সিল্ক, সপুরা সিল্প, রাজশাহী সিল্কসহ বিভিন্ন ব্রান্ড রয়েছে। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে লোক রেখে কাজ করা যাবে না। আমাকে সরাসরি যুক্ত থাকতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো আমার ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার দিকে একটু বেশি খেয়াল দিতে হয়। এজন্য সময়ের অভাবে এখনই আউটলেট দিতে পারছি না।