উদ্যোক্তা/ই-কমার্স

শাশুড়ির টাকায় শারমিন এখন উদ্যোক্তা 

শারমিন আক্তার হিরা একজন স্কুল শিক্ষক। যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল পরিচালনা এবং সেখানে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি হস্তশিল্প নিয়েও কাজ করছেন। হস্তশিল্পের এসব পণ্য নিয়ে পরিচালিত এ উদ্যোগের তিনি নাম দিয়েছেন ‘কারুসুতা’। কারুসুতায় নকশি কাঁথা, নারীদের পোশাক, শিশুদের পোশাক, কুশন কাভারসহ নানা পণ্য পাওয়া যায়।

হিরার ছোট থেকেই বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জে। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী দুজনের চাকরির সুবাদে তিনি পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জেই থাকছেন।

নিজের সম্পর্কে শারমিন বলেন, স্নাতকে থাকা অবস্থায় আমার বিয়ে হয়। সংসার সামলানোর পাশাপাশি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করি। আমার স্বামী চাকরিজীবী। আমাদের দুজনের কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জ হওয়ায় আমার উদ্যোগ নারায়ণগঞ্জ থেকেই পরিচালনা করছি।

শারমিন নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে স্বপ্ন দেখা শুরু করেন স্কুল জীবন থেকে। এসএসসি পরীক্ষার পর ফলাফলের অপেক্ষায় যে বন্ধটা ছিল, তখন তারা কয়েকজন বান্ধবী তাদের এক স্কুল শিক্ষিকার কাছে ব্লক, বাটিক ও ব্রাশ প্রিন্ট শেখা শুরু করেন। 

তিনি বলেন, ম্যামের কাছে যখন ব্লক-বাটিক শেখা শুরু করি, তখন উদ্যোক্তা শব্দের অর্থ জানতাম না। কিন্তু সবসময় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতাম। সে চিন্তা থেকেই আমরা চার বান্ধবী মিলে একটা শপ দেই ২০০৪ সালে। সেটা অবশ্য ৮-৯ মাসের মাথায় বন্ধ করে দিতে হয়। এরপর আরও একবার শুরু করি ২০০৯ সালে। সেটাও বেশিদিন টিকেনি; এক বছরের মাথায় বন্ধ করতে হয়। অবশেষে ২০২০ সালের অক্টোবরে আবারো শুরু করি। আলহামদুলিল্লাহ, এটা আর বন্ধ হয়নি; চলছে ভালোই। কারণ এবার শুরু করার আগে আমি বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ নিয়েছি।

হাতের কাজের পণ্যের জন্য যে সেলাই প্যাটার্ন জানতে হয়, সেগুলো মূলত ছোটবেলায় পরিবার থেকেই পেয়েছেন তিনি। ভেরিয়েশনের জন্য ব্লক বাটিক শিখেছেন তার স্কুল শিক্ষকের কাছে। যা তার উদ্যোক্তা হতে বেশ কাজে দেয়। পরে করোনাকালে উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্সের (উই) সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনার জন্য অনেকগুলো কোর্স করেন। এছাড়া বিসিক থেকে উদ্যোক্তা উন্নয়ন ট্রেনিং এবং ডাব্লিউআইএফআই থেকে বেসিক ডিজিটাল স্কিল কোর্স করেন তিনি। ফলে তার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

তার উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা অনেক সহযোগিতা করেন। তিনি বলেন, কাজ করতে গেলে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকে, এটা থাকবেই। তবে পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ আমাকে আমার উদ্যোগের জন্য সহযোগিতা করে। মূলত আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আরও বেশি উৎসাহ দেন। উদ্যোগের প্রথম বিনিয়োগ ৪ হাজার টাকা আমার শাশুড়ি দিয়েছিলেন। পরে তিনি আবার ১৬ হাজার টাকা দেন। তখন আমি মূলত পণ্য কিনে এনে বিক্রি করতাম। আমার শ্বশুরবাড়ি জামালপুর। সেখান থেকে আমার শ্বশুর একবারে ৪৫ হাজার টাকার কাঁথা কিনে পাঠিয়ে দেন।

শারমিন হিরা বলেন, এতোগুলো কাঁথা দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। কারণ ভাবছিলাম, এগুলো আমি কীভাবে বিক্রি করবো, কত দিনে করবো, শ্বশুরের টাকা কীভাবে ফেরত দেব? কিন্তু আমার শ্বশুর-শাশুড়ি শুধু একটা কথাই বলেছিলেন, ‘টেনশন করো না, তুমি পারবে!’ পরে সাড়ে তিন মাসের মাথায় আমার শ্বশুরের টাকা আমি ফেরত দিতে পেরেছিলাম, আলহামদুলিল্লাহ।

এ নারী উদ্যোক্তা তার পণ্যের ৩০ শতাংশ সরাসরি পাইকারি কিনে এনে বিক্রি করেন। বাকি ৭০ শতাংশ পণ্যগুলোর কাঁচামাল কিনে এনে নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি করেন। এর জন্য তার ১২ জন স্থায়ী কর্মীর ও অস্থায়ী প্রায় ৬০ ৭০জন কর্মী আছে। অফলাইন ও অনলাইন মিলিয়ে প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকার পণ্য বিক্রি করেন তিনি।

এ নারী উদ্যোক্তা বলেন, হাতের কাজের পণ্য তৈরিতে বেশ সময় লাগে। কিন্তু সুঁই-সুতা বা রঙের খেলা আমার খুবই ভালো লাগে। একটা সাধারণ কাপড়কে অসাধারণ করে তোলার যে আনন্দ, সেটা আসলে বুঝানো যাবে না। সৃষ্টিশীল কাজ বরাবরই আমাকে টানে। তাই এ কাজটা বেছে নিয়েছি। 

তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, অনলাইন বিজনেসের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবদান অনস্বীকার্য। বলতে গেলে পুরো অনলাইন সেলটাই এর মাধ্যমে হয়। তবে এতে ভালো করার জন্য উদ্যোক্তাদের অবশ্যই প্রশিক্ষণ নিতে হবে। অন্যথায় সফলতা অর্জন অসম্ভব। আর সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো- উদ্যোক্তা হতে চাইলে উদ্যোগের বিষয়ে পুরোপুরি জ্ঞান থাকতে হবে। সঙ্গে ধৈর্য ও পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে। শেখার আগ্রহ এবং সৃষ্টিশীলতার প্রতি অনীহা থাকলে চলবে না। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা এক নয়— একজন উদ্যোক্তার সেটা মাথায় রাখতে হবে। নিজের স্কিল বৃদ্ধি করে নিজেকে প্রস্তুত করা উচিত।

তবে ইন্টারনেট শাটডাউন এবং দেশের পরিস্থিতি কারণে প্রায়  মাস খানেক বিক্রি ছিলো না বললেই চলে। এতে ক্ষতির পরিমাণ কম করে হলেও ৬০-৭০ হাজার টাকা। আর্থিক ক্ষতি ছাড়া অনেক ক্রেতা কমে গেছে। সবমিলিয়ে বলা যায় শাটডাউনের এখনো রয়ে গেছে— যুক্ত করেন হিরা।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার উদ্যোগকে বড় করার মাধ্যমে আরও কিছু পরিবারের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে চাই। সব সময় স্বপ্ন দেখি, আমার উদ্যোগের নামটা যেন একটা ব্র্যান্ডে পরিণত হয়।