চাকরি করার ইচ্ছে কখনই ছিল না, তবে সবসময়ই নিজে কিছু একটা করার ইচ্ছে ছিল আশির দশকে মেট্রিক পাশ করা ফাতেমা বেগমের। ধারাবাহিকভাবে লেখাপড়া করা অবস্থায় ‘নিজে কিছু করা’র ইচ্ছে থেকে ব্লক-বাটিক, রান্নাসহ বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণমূলক কোর্স করতে থাকেন। নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ২০০১ সালে শুরু করেন উদ্যোক্তা তৈরির কাজ, করেন ব্লক-বাটিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। অবশ্য ২০১৯ সালের দিকে ‘ফাতেমা ক্রিয়েশন’ নামে নিজেই উদ্যোগ শুরু করেন।
সম্প্রতি রাইজিংবিডির কথা হয় উদ্যোক্তা তৈরির এই কারিগরের সঙ্গে। তিনি বলেন, মাস্টার্স পার্ট-১ পরীক্ষা দেওয়ার পরই আমার বিয়ে হয়ে যায়। তারপর তো শ্বশুরবাড়ি চলে আসি। আর আমার চাকরি করার ইচ্ছে কখনোই ছিল না। সবসময় নিজে কিছু একটা করার ইচ্ছে ছিল। লেখাপড়া করা অবস্থায় সে সুযোগটা হয়ে ওঠেনি। পরে ২০০১ সালে মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়ায় বাসাতেই উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করি। এর আগে লেখাপড়ার ব্যস্ততা এবং বিয়ের পর সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে ইচ্ছে থাকলেও শুরু করতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, আমি ট্রেনিং দিতাম বাসাতেই। একসঙ্গে খুব বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দিতাম না, আবার একাধিক ব্যাচও রাখতাম না। একটা ব্যাচের ট্রেনিং শেষ হলে নতুন আরেকটি ব্যাচ তৈরি করতাম। এ ট্রেনিংগুলো ৩-৬ মাস মেয়াদী হতো। এ পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে উদ্যোগ পরিচালনা করছেন।
বাবার চাকরির সুবাদে ফাতেমার ছোটবেলা কেটেছে ঢাকাতেই। পরে অবশ্য তার বাবার ট্রান্সফার হলে নিজ জেলা বরিশালে যেতে হয় তাদের। শ্বশুরবাড়ি ফরিদপুরে হলেও বিয়ের পর স্বামীর চাকরির সুবাদে আবার ঢাকায় থাকা শুরু হয় তার। ওইসময় সংসার-সন্তান সামলানোর পাশাপাশি ব্লক, বাটিক, অ্যাপ্লিক, ড্রেস তৈরি, ট্রিস্টালের শোপিচ ও রান্নার ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। ২০০৫ সালের দিকে যুব উন্নয়নের একটা প্রকল্পে তিনি চাকরি শুরু করেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও অব্যাহত রাখেন।
২০১৯ সালে এসে তার এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন, প্রতিষ্ঠা করেন ‘নারী কর্মসংস্থান সংঘ’ নামে এনজিও। সেখান থেকে দুস্থ নারীদের প্রশিক্ষণ শেষে কাজের সুযোগ করে দেন তিনি। এর পাশাপাশি মোহম্মদপুরের শাহাবুদ্দিন প্লাজায় ‘ফাতেমা ক্রিয়েশন’ নামে একটা শো-রুম দেন এবং একই নামে ফেসবুকে একটি পেজও খোলেন। সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের তৈরিকৃত পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি শুরু করেন।
ফাতেমা বলেন, আমার এ সংস্থাটি মহিলা অধিদপ্তর থেকে রেজিস্টার্ড। করোনার কারণে অফিস বন্ধ হয়ে গেলে বাসা থেকে কাজ করতাম। দুস্থ নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি মনে হলো, আমার আরও কিছু করা দরকার। আমি মোহাম্মদপুরের শাহাবুদ্দিন মার্কেটে একটা শো-রুম দিলাম, সেখানে প্রশিক্ষিত নারীদের তৈরিকৃত পণ্য আমি কিনে নিয়ে আমি বিক্রি করতাম। এতে তারা লাভবান হতো। এখন অবশ্য আমি আমার পণ্যগুলোই বিক্রি করি, আর এগুলোর সবই নিজস্ব কর্মী দিয়ে তৈরি করা। আবার আমার কর্মীরাও কিন্তু উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠছে।
নতুন শো-রুমের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক উদ্যোক্তা আছে, যারা মূলধন না থাকায় পণ্য বিক্রির জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পান না। এজন্য আমি ৩০-৩৫ জন উদ্যোক্তাকে সঙ্গে নিয়ে তাজমোহল রোডে একটি যৌথ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করেছি। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা তাদের পণ্য সহজেই বিক্রি ও প্রচার করতে পারছেন।
তবে এ উদ্যোক্তা কখনো ঋণ গ্রহণ করেননি। তিনি মনে করেন, একটু কৌশলে ব্যবসা করলে ঋণের প্রয়োজন হয় না। তবে বড় প্রতিষ্ঠান হলে ঋণের বিষয়টি সামনে আসে।
যৌথভাবে চালু করা শো-রুমে উদ্যোক্তা ফাতেমা
বিনিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের জমানো টাকা দিয়ে শো-রুম দেই। এতে আমার স্বামীও সহযোগিতা করেছেন। ২০০১ সালে যখন শুরু করি, তখন আমার পুঁজি ছিল ১০ হাজার টাকার মতো। তারপর থেকে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। সেটা দিয়ে ২০২০ সালে শো-রুম দেই। আর দুই মাস আগে দেওয়া তাজমহল রোডে এ প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৩৫ জন উদ্যোক্তার সম্মিলিত বিনিয়োগ।
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সংসারকে সবচেয়ে বড় সমস্যা মনে করেন ফাতেমা বেগম। তিনি বলেন, পরিবার থেকে প্রথমদিকে আসলে কেউ চায় না, ঘরের বউ অন্য কাজ করুক। তবে ম্যানেজ করে নিতে পারলে সমস্যা হয় না। এ ক্ষেত্রে আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষজন অনেক ভালো। আসলে একটা মহিলা যখন কাজ করেন, তাকে সংসার ঠিক রেখে করতে হয়। সংসারে কোনো সমস্যা হলেই মহিলাদের সমস্যা শুরু হয়। অপরদিকে একটা পুরুষ সংসার ফেলে রেখে নির্বিগ্নে তার কর্মস্থল সামলাতে পারেন। কিন্তু মহিলারা পারেন না। সন্তান অসুস্থ হলে, মেহমান আসলে সব দায়িত্ব বাড়ির মহিলার উপর বর্তায়।
তিনি আরও বলেন, সংসার সামলাতে গিয়ে মাঝে মধ্যে কাজ বন্ধ করতে হয়েছে, আবার শুরু করেছি। অবশ্য ২০২০ সালের পর আর বন্ধ হয়নি। ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে গেছে, তখন থেকে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছি। তবে অন্য কোনো সমস্যা নেই।
অন্যান্য উদ্যোক্তাদের মতো ফাতেমা বেগমও অনেকটা অনলাইন নির্ভর। এজন্য ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নেট বন্ধ হওয়ায় তার অনলাইন ভিত্তিক অর্ডারগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তবে শো-রুম থাকায় তার বিকিকিনিতে ততটা প্রভাব পড়েনি।
সরাসরি রপ্তানি না করলেও অনেকে দেশে এসে তাদের প্রবাসী আত্মীয়-স্বজনদের জন্য কাতার, কানাডা, ইতালি, দুবাই, সৌদিসহ বিভিন্ন দেশে তার পণ্য নিয়ে গেছেন। তবে ভারতের সঙ্গে তার ব্লক-বাটিকের পণ্যগুলো নিয়ে কথা চলছিল। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের কারণে সরকার পতন হওয়ায় সেটা আর সফলতার মুখ দেখেনি।
যৌথভাবে চালু করা শো-রুমে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে মাসিক সভা করছেন ফাতেমা
তরুণদের উদ্দেশ্যে ফাতেমা বেগম বলেন, উদ্যোক্তা হতে চাইলে সবার আগে দরকার মনের জোর। যে বিষয়ে কাজ করতে চায়, সেটা বাছাই করার পর ওই বিষয়ে খুবই দক্ষ হতে হবে। এর জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। দক্ষ না হলে সফলতা সম্ভব না। আর সেক্টর বাছাই করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর পাশাপাশি আরেকটা কাজ করা উচিৎ, সেটা হলো- উদ্যোক্তা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। এছাড়া পরিচিত কোনো উদ্যোক্তা থাকলে তারও সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। এভাবে আস্তে আস্তে কাজ শুরু করে যে কেউ সফল উদ্যোক্তা হতে পারে।
তিনি বলেন, কাউকে অনেক টাকা আয় করতে দেখে কোনো কিছু ঠিকমতো না জেনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, এটা করলে হবে না। এমনটা করলে নিশ্চিত ব্যর্থ হতে হবে এবং সম্পূর্ণ বিনিয়োগ লোকসান হওয়ার সম্ভবনা থাকতে পারে। অন্যদিকে, অনলাইন উদ্যোক্তাদের জন্য খুবই ভালো একটা জায়গা। এর মাধ্যমে যে কোনো জায়াগায় বসে দেশে-বিদেশে সমান তালে কাজ করা যায়। তবে এর জন্য ইন্টারনেট, মোবাইল বা কম্পিউটার সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। আমি বোঝাতে চাচ্ছি, ভালোভাবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার বিষয়টি।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এ উদ্যোক্তা তৈরির কারিগর বলেন, আমি কলেজে থাকতে রান্না, সেলাই, ব্লক-বাটিক, শো-পিচ, প্রিন্ট ইত্যাদির কাজের উপর বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করি। আর পরিবারিকভাবেও তো অনেককিছু শিখেছিলাম। এভাবে নিজেকে তৈরি করি। কারণ কোনো বিষয়ে অভিজ্ঞ না হলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না। বর্তমানে আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছয় মাস, এক বছর ইত্যাদি মেয়াদী কোর্সে প্রশিক্ষণ ও ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদান করছে। সে সব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা হওয়া যেতে পারে। আমি যে কাজে হাত দিয়েছি, সেটার উপর একাধিক প্রশিক্ষণ নিয়েছি। কারণ আমি জানি, প্রশিক্ষণ ছাড়া সফলতা সম্ভব না। এক কথায় যদি বলি, না জেনে কোনো বিষয়ে হাত দেওয়া একেবারেই উচিৎ না।
ইতোমধ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে তিনি ২০-২৫টির বেশি পুরস্কার পেয়েছেন। আর্থিক সফলতার প্রশ্নে এ নারী উদ্যোক্তা বলেন, লাভ শুধু পণ্য বিক্রিতে নয়, কাঁচামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রেও অনেকটা নির্ভর করে। কাঁচামাল এমন জায়গা থেকে নিতে হবে, যার থেকে কম দামে যাতে কেউ দিতে না পারে। দ্বিতীয় বা তৃতীয় হাত ঘুরলেই লোকসান হতে পারে বা আপনার পণ্যের মূল্য বেশি হয়ে যেতে পারে। এতে লাভের পরিমাণ কম বা বিক্রির পরিমাণ কমে যেতে পারে।