প্রদীপ হাঁসদা, পারিবারিক অভাব-অনটনে অষ্টম শ্রেণিতেই থেমে যায় পড়াশোনা। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার লালদিঘী গ্রামের বেকার প্রদীপ একদিন খবর পেলেন, বেসরকারি সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি) আদিবাসী তরুণদের কারিগরি দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। প্রদীপ সেখানে অটোমোবাইল রিপেয়ারিং ট্রেডে আবেদন করেন এবং নির্বাচিত হন। গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ী এলাকার ‘টিটো ওয়ার্কশপ’-এ ১০ মাসের ট্রেনিং শেষে সেখানেই কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে চারদিকে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
কিছুদিন পর বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে গোপালপুর মোড়ে নিজেই গড়ে তোলেন ‘প্রদীপ মোটরসাইকেল সার্ভিসিং সেন্টার’। কর্মী হিসেবে সঙ্গে নেন বোধিনাথ সরেন ও বিশ্বজিৎ ওরাও নামে দুই আদিবাসী তরুণকে।
উদ্যমী প্রদীপ এখন মোটরসাইকেল মেরামতে এলাকায় পরিচিত নাম। মাসে তার আয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা। নিজের বেকারত্ব ঘুচিয়ে আরো দুইজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন তিনি।
শেরপুরের সুমি বিশ্বাসের জীবনেও একই ঘটনা ঘটেছে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত সুমি বিশ্বাস ১০ মাসব্যাপী ফ্যান ও মোটর মেরামতের প্রশিক্ষণ নেন অমিত বিশ্বাসের ওয়ার্কশপে। প্রশিক্ষণে দক্ষ হয়ে ওঠার পর সুমিকে নিজের দোকানেই চাকরি দেন অমিত। সুমিও এখন স্বাবলম্বী। তার মাসিক আয় প্রায় ১০ হাজার টাকা।
জেলা-উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন বাজার ও ওয়ার্কশপে আইইডির সহায়তায় প্রশিক্ষণ থেকে কারিগরি দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে এসব যুব ও যুব নারী স্বাবলম্বী হয়েছেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন ২০৩ জন আদিবাসী। সমাজের অন্য মানুষদের সঙ্গে বর্তমানে এসব আদিবাসীদের দূরত্ব কমেছে। পাশাপাশি সামাজিক-আর্থিক সম্পর্ক হয়েছে অনেক আন্তরিক। সমাজে মর্যাদাও বেড়েছে এসব কর্মজীবী আদিবাসীদের। প্রশিক্ষিত এসব আদিবাসী যুবদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ফলে তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে সচেতনতা বাড়ার পাশাপাশি এসব পরিবারে বেড়েছে শিক্ষাগ্রহণের হারও।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব আদিবাসীরা জানিয়েছেন, পারিবারিক অভাব-অনটনে তাদের পড়ালেখা হয়নি। কৃষিকাজের বাইরে বাড়তি দক্ষতা না থাকায় কোনো কাজ পাচ্ছিলেন না তারা। আইইডির আইপি ফেলোর মাধ্যমে তারা বিকল্প কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কারিগরি দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এখন তারা সব মিলিয়ে ভালো আছেন।
নিজের বেকারত্ব ঘুচিয়ে আরো দুইজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন প্রদীপ
প্রশিক্ষিত এই আদিবাসীদের মধ্যে ১৫৮ জন সরাসরি আইইডির তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। স্থানীয় বাজার ও ওয়ার্কশপে আইইডির তরফ থেকে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। প্রশিক্ষণকালীন এসব আদিবাসীদের যাতায়াত ও খাবার বাবদ ১০ মাস ধরে প্রত্যেককে তিন হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়। আইইডির এই সহায়তায় আদিবাসী সমাজে আগ্রহ সৃষ্টি হলে তারা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে ৪৫ জনকে কারিগরি দক্ষতা প্রশিক্ষণ দেয়। যে প্রশিক্ষণ তাদের বেকারত্ব ঘুচিয়ে আর্থিক সচ্ছলতা এনে দিয়েছে। মূলস্রোত নাগরিকদের সাথে বর্তমানে তাদের দূরত্ব কমেছে আর সামাজিক-আর্থিক সম্পর্ক হয়েছে আগের চেয়ে অনেক আন্তরিক। সমাজে সবার মর্যাদাও বেড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, ‘‘আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের নিয়ে স্থানীয়ভাবে এরকম প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের বিষয়টি আরও ব্যাপকভাবে করা দরকার। এ ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আরও প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসা উচিৎ। তাতে একদিকে বেকার সমস্যা কমবে, অপরদিকে আদিবাসীরা সমাজের সকলের সঙ্গে থেকে কাজ করলে তাদের আর্থ-সামাজিক মান উন্নয়ন হবে।’’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইশতিয়াক রায়হান মনে করেন, আদিবাসীরা এমনিতেই সমাজের অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে খুব বেশি মেলামেশা করতে চান না বা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। সমাজে পিছিয়ে পড়া এসব আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের সঙ্গে রেখে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যারা করছেন, তারা খুব ভালো একটা কাজ করছেন। এরকম কাজ ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তিনি রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, ‘‘আদিবাসীসহ সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে আরও বেশি করে এমন সব কাজে সম্পৃক্ত করা দরকার। এ ব্যাপারে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।’’
রাজশাহী, শেরপুর, দিনাজপুর, নাটোর ও গাইবান্ধা জেলায় আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের কারিগরি দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে কাজ করছে আইইডি। বর্তমানে এ কার্যক্রম শেরপুর, গাইবান্ধা ও রাজশাহী জেলায় চলমান আছে। ২০১৬ থেকে ২০২৪ এপ্রিল পর্যন্ত আটটি জেলায় ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী মোট ৯৬৭ জন যুবকে বিভিন্ন ট্রেডে কারিগরি দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দিয়েছে আইইডি।