পৃথিবীর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে হাজার রহস্য। শত-সহস্র বছর রহস্যগুলো মানুষের ভাবনার খোরাক জুগিয়ে আসছে। নাজকা লাইন বা নাজকা নকশা এমনই এক রহস্যের নাম।
নাজকা লাইন হচ্ছে মরুভূমির বুকে এক আশ্চর্য নকশা। একদল গবেষক ধারণা করেন, হাজার হাজার বছর আগে নাজকা সভ্যতার বাসিন্দারা বছরের পর বছর পরিশ্রম করে এই নকশা এঁকেছিল। আবার অন্য একদল গবেষক মনে করেন, এলিয়েনের দল পৃথিবীতে এসে নকশাগুলো এঁকেছে। তবে নকশাগুলো প্রাচীন সভ্যতা কিংবা এলিয়েন যাদের দ্বারাই আঁকা হোক না কেন নাজকা লাইন এখনও পৃথিবীর মানুষের কাছে এক বিস্ময়।
নাজকা মরুভূমি পেরুর দক্ষিণে অবস্থিত। রাজধানী লিমা শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় দুইশ মাইল। মরুভূমির ৩১০ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিভিন্ন স্থানে আঁকা আছে প্রায় বারোশ নকশা। এদের মধ্যে আটশ সমান্তরাল নকশা, তিনশ জ্যামিতিক নকশা এবং ৭০টির মতো জীবজন্তু এবং গাছপালার নকশা রয়েছে। জীবজন্তুর নকশাগুলো ৫০ থেকে বারোশ ফুট এবং সমান্তরালগুলোর কোনো কোনোটি ৩০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত।
নাজকা লাইন প্রথম মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় ১৯২৬ সালে। আর্কিওলজিস্ট তোরিবিও মেহিয়া কেসপ পেরুর শুষ্ক মালভূমি অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে কিছু অদ্ভুত রেখা দেখতে পান। তার কাছে মনে হয় কেউ যেন রেখাগুলো দিয়ে কিছু অতিকায় জ্যামিতিক নকশা তৈরি করেছে মরুভূমির বুকে। তবে ভূমি থেকে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত এই নকশাগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব ছিল না। এরপর ১৯৩০ সালে ওই এলাকা দিয়ে বিমান চলাচল শুরু হয়। বিমানে যাবার সময় পাইলটরা এই বিশাল নকশা দেখে অবাক হন! বিভিন্ন পত্রিকায় খবর ছাপা হয়। তবে অনেকেই একে দৃষ্টিভ্রম বলে উল্লেখ করেন। এরপর দীর্ঘদিন এই নকশা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি।
এরপর ১৯৪১ সালে আমেরিকান অধ্যাপক পল কসক এই রেখার রহস্য উদঘাটনে ব্যাপক গবেষণা শুরু করেন। তিনি জার্মান গণিতজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ মারিয়া রাইখের প্রদত্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে গবেষণা শুরু করেন। মারিয়া রাইখকে বলা হয় লেডি অব দ্যা লাইন। কারণ তিনি দীর্ঘদিন ধরেই নাজকা লাইন নিয়ে গবেষণা করছেন। মূলত এরপর থেকে মানুষের মনে এই রেখা সম্পর্কে তীব্র কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। রাইখ এবং কসক তাদের গবেষণায় নাজকা লাইন সম্পর্কে বলেন, এই রেখাগুলো আঁকা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব সাতশ খ্রিস্টাব্দে। নাজকা সভ্যতার বাসিন্দারা জ্যোর্তিবিদ্যা গবেষণার জন্য এই নকশাগুলো এঁকেছিল। গবেষণায় জানা গেছে যে, নাজকাতে নকশা ও ছবি আঁকা হয়েছে আয়রন অক্সাইডসমৃদ্ধ লালচে-বাদামি নুড়ি পাথর সরিয়ে ভেতরের অপেক্ষাকৃত সাদা মাটি উন্মোচন করে। নকশাগুলোর বেশিরভাগ লাইনই ১২ থেকে ১৫ ইঞ্চি গভীর।
তবে তাদের এই গবেষণা বেশ কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। কারণ তখনকার মানুষের কাছে না ছিল কোনো উন্নত প্রযুক্তি বা উন্নত যন্ত্রপাতি। তাহলে পাথুরে মরুতে নকশাগুলো আঁকা হলো কীভাবে? এছাড়া আরো একটি প্রশ্ন অবধারতিভাবে এসে যায় যে- নকশাগুলো ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা তা তাঁরা কীভাবে দেখেছিল? কারণ সঠিকভাবে আঁকা হচ্ছে কিনা দেখার জন্য কাউকে না কাউকে অনেক উপরে উঠতেই হয়েছিল। এটা কী করে সম্ভব? তখন তো উড়োজাহাজ আবিষ্কার হয়নি। আর আশেপাশে তেমন কোন উঁচু পাহাড়ও নেই।
নাজকা লাইনের বেশিরভাগ ছবি এতো বড় যে দেখতে হলে কমপক্ষে একশ ফুট উপরে উঠতে হবে। প্রাচীন ওই সভ্যতার পক্ষে এটা ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব। ধারণা করা হয় নাজকার প্রাচীন বাসিন্দারা বেলুন জাতীয় কোন যান আবিষ্কার করেছিল। তা দিয়ে তারা আকাশে উড়তে পারত। যদিও এ যুক্তি অনেকেই মানতে চান না। কারণ তারা যদি বেলুন আবিষ্কার করেই থাকতো তাহলে সে প্রযুক্তি হঠাৎ হারিয়ে গেল কীভাবে? তাছাড়া বেলুন ব্যবহারের কোনো প্রমাণও তাদের সভ্যতার ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যায় না। আবার অনেক গবেষক ধারণা করেন, প্রথমে ছোট নকশা আঁকা হতো তারপর এর অনুকরণে বড় করে মূল নকশা আঁকা হতো। কিন্তু এখানেও পর্যবেক্ষণের সমস্যা রয়ে যায়, তাই এই ধারণা তেমন গ্রহণযোগ্য নয়।
এই নকশাগুলো আঁকা হয়েছে মরু অঞ্চলের শক্ত পাথুরে জমির উপর। এই এলাকায় সার বছর বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। তাই এমন একটি স্থানে এ ধরনের জটিল সব নকশা আর ছবি আঁকার মানে কী হতে পারে তার কূলকিনারা খুঁজে পায়নি গবেষকরা। তবে কিছু গবেষক একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। জোহান রেইনহার্ড তেমন একজন গবেষক। তিনি তার ‘নাজকা লাইন: আ নিউ পারসপেক্টিভ অন দেয়ার অরিজিন এন্ড মিনিং’ বইতে দাবি করেন, বৃষ্টিপাতের জন্য প্রার্থনা, বৃষ্টির পানি প্রবাহ ও ভালো ফসলের আশায় নকশাগুলো আঁকা হয়েছিল। কারণ প্রাচীন কাল থেকে এটি পৃথিবীর অন্যতম শুষ্ক অঞ্চল। বছরে সর্বোচ্চ ২০ মিনিটের মতো বৃষ্টিপাত হয় এখানে। তিনি তার গবেষণার প্রমাণস্বরূপ বেশ কিছু সংকেতের কথা উল্লেখ করেন। যেমন মাকড়সার নকশাগুলোকে তিনি বৃষ্টির প্রতীক, হামিংবার্ডকে উর্বরতা, বানরের নকশাগুলোকে পানির অপ্রতুলতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ এইসব সংকেতগুলো অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতায় উল্লেখিত বিষয়ের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া তিনি মনে করেন, প্রাচীন নাজকার বাসিন্দারা তাদের ধর্মীয় রীতিনীতির অংশ হিসেবেও এই নকশাগুলো তৈরি করতে পারেন। তবে তার গবেষণাও বেশ কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।
গবেষকরা নাজকা লাইনের রহস্য সম্পর্কে কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি বলে একটি আজব তত্ত্ব প্রাচীনকাল থেকেই চালু রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এলিয়েনদের সহায়তায় নাজকার প্রাচীন বাসিন্দারাই এগুলো তৈরি করেছিল। এটা ছিল এলিয়েনদের বিমানবন্দর। যেখানে এলিয়েনদের স্পেসশিপ ওঠানামা করত। আর এখানে আঁকা সব নকশা মূলত স্পেসশিপ ওঠানামার সংকেত। কারণ এখানে বেশকিছু নকশা রানওয়ের মতো করে আঁকা। তবে এলিয়েন তত্ত্ব বেশ আকর্ষণীয় এবং চমকপ্রদ হলেও পর্যাপ্ত কোনো প্রমাণ না থাকায় এই তত্ত্বের সত্যতা নিরূপণের সুযোগ নেই।
তাই তো, সেই ১৯৩০ সালে আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে আজও এই নাজকা লাইনের রহস্যের সমাধান হয়নি। ফলে এর প্রকৃত ইতিহাস জানতে আরও অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। ঢাকা/তারা