মৃত আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের দেওয়া হয় নিয়মিত খাবার। নিয়মিত করানো হয় গোসল, তাদের সঙ্গে গল্পও করা হয়। তোরাজা উপজাতির রীতি নীতির কথা এভাবেই বলছিলেন চিত্র সাংবাদিক ক্লাউদিও।
তার ভাষ্যমতে, তাদের এই প্রথাটি সবাইকে হতবাক করে। যদিও সব ধর্মই মৃত্যুর পর সমাহিত বা মৃতদেহের কৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্মান জানিয়ে বিদায় দেওয়া হয়। কিন্তু আজব এক রীতি চালু রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার পাঙ্গালায়।
সেখানে মৃতদেহের সঙ্গে বসবাস করেন স্বজনরা। শুধু তা-ই নয়, মৃতকে নতুন পোশাক পরানো, এমনকি খাওয়ানোও হয়। মানুষ মরণশীল হলেও এই কথাটি মানেন না তোরাজা জনগোষ্ঠী। তাদের জনগোষ্ঠীর কেউ ইহজগত ত্যাগ করলে তাকে সমাহিত করা হয় না।
ইন্দোনেশিয়ার একটি গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার বালি থেকে ১৮০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে দক্ষিণ সুলায়েসির পাঙ্গালায় একটি পার্বত্য অঞ্চলে তোরাজা জনগণের বসবাস। তারা মৃতদের মৃতদেহকে মমি করে এবং তাদের সংরক্ষিত দেহের যত্ম নেয়। এমনভাবে যত্ম নেয় যেন তারা এখনও বেঁচে আছে। তোরাজানরা বিশ্বাস করে যে, মৃত্যুর পরে আত্মা ঘরে থাকে। তাই মৃতদের খাদ্য, বস্ত্র, জল, সিগারেট এমনকি চিকিৎসাও করা হয়। তোরাজা লোকেরা তাদের মৃত আত্মীয়দের বাড়িতে রাখে এবং আলিঙ্গন করে।
অবশেষে যখন তাদের কবর দেওয়া হয়, তারা বছরে একবার উদযাপনের জন্য তাদের খনন করে। ইন্দোনেশিয়ার পাঙ্গালায় তোরাজা সম্প্রদায় এমনই রীতি যুগ যুগ ধরে মেনে আসছেন। তারা মূলত খ্রিষ্টান।
তোরাজাদের আচার অনুষ্ঠান দেখে ছবি তুলেছিলেন চিত্রসাংবাদিক ক্লাউদিও। তিনি তোরাজা জনগণের আচার-অনুষ্ঠানের ছবি তুলতে এই অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন।
ক্লাউদিও বলেন, মৃতদেহগুলিকে বাড়ির একটি পৃথক কক্ষে আরামদায়কভাবে বিছানায় রাখা হয়েছে। তারা পুরো দেহ পরিষ্কার করে নতুন পোশাক পরান। প্রিয়জনরা যাতে মনে না করেন যে, তাদের প্রতি অবহেলা করা হচ্ছে। তারা সময়মতো কফিনের ঢাকনা খুলে প্রিয়জনের সঙ্গে গল্পও করেন।
এভাবে তারা এক সপ্তাহ, একমাস বা এক বছর প্রিয়জনকে নিজের কাছে রেখে দেন। তারা সামর্থ অনুযায়ী যত দিন ইচ্ছা নিজের কাছে মৃতদেহ রেখে দেন।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিককে ইয়োহানা পালংদা নামে এক তোরাজা মহিলা বলেন, আমার মা হঠাৎ মারা গেছেন, তাই আমরা এখনও তাকে যেতে দিতে প্রস্তুত নই। আমি তাকে খুব তাড়াতাড়ি কবর দেওয়া মেনে নিতে পারব না।
তোরাজারা একটি মৃতদেহকে সর্বোত্তম আকৃতিতে থাকা নিশ্চিত করতে অনেক চেষ্টা কর। তারা মৃতদেহ ভালোভাবে সংরক্ষণ করে, না করলে পঁচে যাবে। যদিও সেটি বেশ ব্যয় সাপেক্ষ। এজন্য বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দরকার হয় তাদের। অনেক সময় মৃতদেহ থেকে তীব্র দুর্গন্ধ আসে। তাই পরিবারের লোকেরা গন্ধ ঢাকতে শুকনো গাছপালা শরীরের পাশে সংরক্ষণ করে। এছাড়া তাদের ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তাদের চামড়া এবং মাংস ক্ষয় এবং পচন থেকে রক্ষা করা হয়। তাদের দেহে স্থানীয়ভাবে তৈরি ফর্মালডিহাইড এবং পানির আবরণ দেওয়া হয়।
তাদের সামাজিক রীতি হলো, মৃতদের সমাধি বা পাথরের কবরে দাফন করার পরেও, তারা আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ‘মা’ নেনে’ নামে পরিচিত একটি আচার-অনুষ্ঠানে মৃতদের তাদের কবর থেকে বের করে আনা হয়, তাদের কফিন থেকে বের করে আনা হয়, পোকামাকড় এবং ময়লা ধুয়ে ফেলা হয়, নতুন কাপড় দেওয়া হয় এবং গ্রামে আনা হয়। মা’ নেনে অর্থ পূর্বপুরুষদের যত্ম নেওয়া এবং ঐতিহ্যগতভাবে আগস্ট মাসে পালন করা হয়।
ক্লাউদিও বলেন, তোরাজানরা খুব অল্প বয়স থেকেই মৃত্যুর সাথে মোকাবিলা করতে এবং জীবনযাত্রার অংশ হিসাবে গ্রহণ করতে শিখে। তারা জন্মের পর থেকেই বিশ্বাস করেন যে, মৃত্যু মানে জীবনের শেষ নয় বরং জীবনযাত্রার একটি অংশ। তারা বিশ্বাস করে, মৃত্যু মানেই আত্মার দেহ ত্যাগ নয়। মৃত্যু মানে তিনি জীবিত কিন্তু ভীষণ অসুস্থ। তাই হাঁটাচলা, খাওয়া এমনকি কথা বলতে পারেন না। তাই এ সম্প্রদায়ের কোনো আত্মীয়ের মৃত্যু হলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বদলে তার বিশেষ যত্ম নেওয়া হয়।
তিনি বলেন, যতক্ষণ না পরিবার একটি সঠিক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বহন করতে পারে। এরপর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়। যার জন্য সহজেই পরিবারের জাত অনুসারে ৫০,০০০ থেকে ৫০০,০০০ টাকা খরচ হয়। তোরাজারা বিশ্বাস করে, মৃত্যুর পর মহিষই তাদের স্বর্গের রাস্তা দেখায়। তাই একজন মৃত ব্যক্তির জন্য অন্তত একটি মহিষ বলি দেওয়া বাধ্যতামূলক। একটি মধ্যবিত্ত পরিবার একজনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ২৪টি মহিষ বলি দেয়। সামর্থ থাকলে বলির সংখ্যা বাড়তে পারে। তোরাজা মিথ অনুসারে, তাদের কাছে প্রথম বলি দেওয়া মহিষ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা মানে প্রিয়জনের মৃত্যু। তারপর যত বেশি মহিষ বলি দেওয়া হবে, তত তাড়াতাড়ি আত্মা স্বর্গে পৌঁছে যাবে। যাদের অনেক মহিষ কেনার সামর্থ নেই, তারা একটি মহিষই বলি দেয়। তবে এতে ওই ব্যক্তির মৃত্যু নিশ্চিত হলেও তার আত্মা স্বর্গে পৌঁছতে না পারার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তোরাজারা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া খুব ঘটা করে পালন করেন। তা না হলে আত্মা স্বর্গ যাবে না। আর এর জন্য মহিষ প্রয়োজন। মহিষ কেনার টাকা এবং অন্ত্যেষ্টিরীতির খরচ জমানোর জন্য তারা মৃতদেহ বাড়িতে রাখেন। বলি দেওয়ার পর মহিষের মাংস উপস্থিত আত্মীয়দের খাওয়ানো হয়।
তারা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর মৃতদেহসহ কফিন নির্দিষ্ট কোন গুহায় রেখে দেন। পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় এমন অনেক গুহা রয়েছে সেখানে। কিন্তু তারপরও বছরে একবার আত্মীয়রা সেই গুহার কাছে যান। কফিন থেকে মৃতদেহ তুলে পরিষ্কার করে নতুন পোশাক পরান, খাওয়ান। তাদের বিশ্বাস, মৃতদের প্রতি সম্মান জানালে তাদের আয়ু বাড়বে এবং সৌভাগ্য অর্জিত হবে।