বাবা দিবস

অক্লান্ত এক ভালোবাসার নাম বাবা

অ‌্যাডমিশন কোচিংয়ের জন্য খুলনায় থাকতাম। আব্বু তখন প্রতি মাসে খুলনা যেত পেনশন তুলতে। খুলনাতে গিয়ে ফোন করে বলত, ‘আব্বু, আমি তো এসেছি তুমি বের হও।’ আমি দ্রুত তৈরি হয়ে হোস্টেল থেকে বের হতাম। আমার যত কেনাকাটা থাকত আব্বুর সাথে করতাম। আসার সময় টাকা দিয়ে বলত, আর তো দেখা হচ্ছে না। ফিরতে হবে তো তোমাকে মা? যখন হোস্টেলের পথে পা বাড়াতাম, কিছুদূর হেঁটে পেছন ফিরে দেখতাম, মানুষটা ওখানেই দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। দেখে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠত। স্বার্থপরের মতো দ্বিতীয় বার তাকাতাম না ব্যথাটা সহ্য করার ভয়ে।

প্রথমবার যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে মেয়েটাকে রাখতে এসেছিল, সেবারও হলের গেটে ঢুকতে গিয়ে পেছন ফিরে দেখি, মানুষটা দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। সে তাকানোটার ভেতর কী ছিল জানি না। তবে বরাবরের মতোই বুকে খচ করে বেঁধেছিল।

বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার সময় তাকে বারবার মানা করা সত্ত্বেও অনেকটা পথ এগিয়ে দিত সিএনজিতে। বাস ছেড়ে দেওয়ার পর জানালা দিয়ে দেখতাম, মানুষটা চলন্ত বাসটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে দৃষ্টিটা যেন খানিকটা অসহায়রের মতো লাগত। মনে হতো—বাধ্য করে তার মেয়েকে কেউ নিয়ে যাচ্ছে। 

প্রথম বাসার বাইরে পা রেখেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের উদ্দেশ‌্যে। তাছাড়া খুব একটা বাসা ছেড়ে কোথাও থাকিনি। খুব প্রয়োজন না হলে আত্নীয় বাড়িও যেতাম না। আব্বুও যেতে দিতে চাইত না। আমার আম্মু আর বোনের বেলায় ততটা অমত ছিল না আমার বেলায় যতটা ছিল। কখনও ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ‌্যে আম্মুর সাথে যেতাম বাইরে। থাকা হতো আত্মীয়ের বাসায়। বাসায় ফিরলে খালামনির কাছে শুনতাম, আব্বু শুধু বলছিল বারবার, ‘তাছলিমা, আমার মা নেই বাসায়, আমার পুরো বাসাটাই ফাকা লাগছে।’ খালামনি হেসে বলত, ‘দুলাভাই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে কীভাবে থাকবেন।’

একবার খালামনির গুরুতর অসুস্থতার জন্য তার কাছে ছিলাম কয়েক দিন। তিনি কেঁদে দিয়ে বলেছিল, ‘জানি, তোর আব্বু ঢাকা থেকে এসে তোকে বাসায় না পেলে রাগ করবে। কিন্তু তুই চলে গেলে তোর মতো যত্ন কেউ করবে না আমাকে। থেকে যা ক’দিন।’ ওনার কথায় ছিলামও। কিন্তু বাসায় গিয়ে শুনি, আমাকে বাসায় না দেখতে পেয়ে আব্বু রাগারাগি করে অসুস্থ হয়ে গেছে।

আব্বু বাজার হাতে যখন বাসায় ফিরত, তার প্রথম কথাটা থাকত, 'আমার মা কোথায়? দেখো, কী এনেছি।’

বাবা বরাবর আমার হাতেই খাবার, পানি, ওষুধ খেতে অভ্যস্ত ছিল। আমি ছুটিতে বাসায় গেলে বোনকে বলতাম, ‘আমি না থাকলে আব্বুর কাজগুলো কে করে দেয়?’ ও বলে, ‘নিজেই করে। ডাকে না কাউকে।’

তবে আব্বু প্রায়ই রসিকতা করে বলত, ‘আমার ছোট মেয়ের সাথে তোমার তুলনা হয় নাকি।' বাপ মেয়ে দুজন একসাথে বেশ মজা করত আমার সঙ্গে এমন খুনসুটি করে। আমিও একটু মিছে রাগ দেখিয়ে বলতাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো বলবা।’

কিন্তু খালামনি যখন আমার আড়ালে তাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘দুলাভাই, আপনার সব ছেলেমেয়ের ভেতর কাকে সবথেকে ভালো বলবেন? উত্তর একজনই হতে হবে।’

আব্বু বলেছিল, ‘সবাই যার যার জায়গা থেকে ভালো। কিন্তু জয়নবের মন-মানসিকতা, বিশেষ করে ওর মানবতাবোধ, এগুলোর সাথে তুলনা কমই হয় অন্যদের।’

বরাবরের মতো মানুষটি অতি গল্পপ্রিয় ছিল। তার গল্পের শেষ ছিল না। সবার সাথেই মন খুলে কথা বলত, গল্প করত। অনেক সময় আগ্রহ না থাকলেও শুনতাম গল্প। বাবা আনমনে বলে চলত তার জীবনের ইতিহাস, দর্শন! অধ্যাপনা জীবনের গল্প-কাহিনী। সারা দেশে তার শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে আছে, কথাটার সাথে খানিকটা সন্তুষ্টির হাসি।

অনেক সময় শুনতে বোরিং লাগলেও আগ্রহ দেখাতাম। কারণ, মানুষটা এতে খুশি হয়। মনে পড়ে, কয়েক দিন আগে ফোন দিয়ে বলছিল, আজ দেখে আসলাম, আমার হাতে করা মাদ্রাসাটা কত বড় হয়েছে, কত ছাত্র-ছাত্রী পড়ে।

আমি ক্লান্ত শরীরে হু হা বলে সাড়া দিচ্ছিলাম আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও। কারণ, বুঝতাম, মানুষটার শান্তি কখনো ধন-সম্পদে ছিল না। শান্তি ছিল তো এগুলোতেই। এই অর্জনগুলোর মধ্যে বাবা খুজে পেত সন্তুষ্টি, আনন্দ।

আমি নিজে হাতে স্কুল কলেজে আমার অফিসিয়াল কাজ খুব কম করেছি বললেই চলে। আমার সাইনটাও যেন বাবা দিতে পারলে বাঁচত! বৃদ্ধ বয়সেও কত কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা দিইয়েছে মেয়েকে নিজে সঙ্গে করে। সন্তানের সফলতা বাবাকে যতটা খুশি করতে পারে আর কিছু তা পারে না। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন চান্স পেয়েছিলাম, আব্বু আমার ম্যারিট লিস্টের আশপাশে আরো ২৫ জনের রেজাল্ট নামিয়েছিল। আম্মুকে বলেছিল, কতটা প্রতিযোগিতা করে আমার মেয়ে টিকেছে জানো? ২৫ জনের ব্যবধান সব মিলিয়ে মাত্র ৪ বা ৫ হয় নাকি।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সব কাজ নিজে হাতে করেছে আব্বু। ভর্তি ফরম, এমনকি আমার ভর্তির রশিদ খাতাটার উপরেও তার হাতে লেখা আমার নামসহ সবকিছু।

বাবা সব সময় আমাদের শেখাতেন নিয়মনীতি, কলাকৌশল। সব সময়  নীতি-নৈতিকতা, আদব শিক্ষা দিতেন। কোন কাজে ভুল হলে বলত, এই তো তুমি ভাইভাতে ফেল করবা এমন করলে। কিন্তু বড় রকম প্রেশার দিতেন না। অন্যের সাইকোলজি বুঝে চলার চেষ্টা করত সব সময়।

প্রতিদিন কথা বলা সত্ত্বেও আব্বু খুব মমতা দিয়ে ঢং করে বলত, ‘আম্মু, তুমি তো ভুলেই গেছ। ফোনই দাও না আমাকে। আমার রুমমেট বলত, ইস! তুই তোর আব্বুকে কি কিউট করে আব্বু বলে ডাকিস! কথা বলিস। আসলে বাবা-মা যেমন ছেলেমেয়ের সাথে মমতা দিয়ে কথা বলে তারাও তত সুন্দর করে কথা বলে তাদের সাথে। আংকেলের সাথে কথা বলেছি, উনি খুব মমতা দিয়ে কথা বলে। এজন্য তুইও এত সুন্দর করে কথা বলিস।’

ক্যাম্পাসে ফেরার সময় কিছু সময় পরপর ফোন দিত, কত দূর পৌঁছেছিস। হলে পৌছাবার পর যেন মানুষটা প্রাণ ফিরে পেত। খুব কাছে কোথাও যাচ্ছি শুনলেও ‘হলে ফিরেছি’ কথাটা না শোনা অবধি শান্তি ছিল না তার। এমনকি ছোট-খাট কাজের জন্য একটু বাইরে যাচ্ছি শুনলেও বলত, ‘বান্ধবীকে নিয়ে যাও সাথে।’

একবার কাজের জন্য বাসার বাহিরে গিয়েছিল আব্বু। ফিরতে রাত হচ্ছিল দেখে ফোন দিয়েছিলাম, কিন্তু ফোন রিসিভ করছিল না। ফুপুকে বললাম, ‘আব্বু বাসার ফোন ধরবে না। সে সারপ্রাইজ দেয় ফিরে। আপনি একটু অন্য কাউকে দিতে বলেন ফোন।’

কিন্তু ফোন বেজে চলে, কারোটাই ধরে না। জানি না কী ভেবেছিলাম, অবুঝের মতো চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছিলাম। ফুপু বলে, ‘তোর ভাইয়ের ফোন ধরেছে মাত্র। শান্ত হ, মা।’

কান্না না থামাতে ফুপু আব্বুকে ফোনে রেখে লাউড স্পিকার অন করে আমার কাছে ধরে রেখেছিল। শুনছিলাম, আব্বু বলছে, ‘আম্মা, এই তো চলে আসছি। তুমি কান্নাকাটি করছ কেন মা? চলে আসছি, মা। আমার কিছু হয়নি। অফিসারের সাথে কথা বলসিলাম তাই ফোন তুলিনি।‘

একদিন রাতে শুনছিলাম আব্বু আম্মুকে বলছে, ‘মনে হয়, বেশি দিন বাঁচব না। সমবয়সী কেউ বেঁচে নেই।‘

সারা রাত কেঁদে মন খারাপ করে কাটিয়েছিলাম। আব্বু শুনতে পেরে আমাকে হেসে দিয়ে বলেছিল, ‘ধুর পাগল মেয়ে, আল্লাহ চায় তো আরো অনেক দিন হায়াত দেবেন।’

কিছুদিন আগে হঠাৎ শুনি, আমার বান্ধবী শুভ্রার বাবা মারা গেছে। স্বার্থপরের মতো মনটা নিজের বাবার জন্য কেঁদে উঠেছিল। দেখি, তখনই আব্বু ফোন দিয়েছে। অনেক সুন্দরমতো বুঝিয়ে বলছিলাম, ‘আব্বু, তুমি টেনশন করবা না। প্রেসারের ওষুধ ঠিকমতো খাবা। আমার টাকা যখন পারো দিও। কোনকিছু নিয়ে চাপ নিবা না।’ এসব কথা বলে মন শান্ত হয়েছিল।

কিন্তু এবার! এবার বাবা আমাকে হেসে হেসে শান্ত্বনা দেয়নি এটা বলে—‘পাগল মেয়ে! আল্লাহ চায় তো অনেক দিন বাঁচব।'

এবার আল্লাহই আমাকে শান্ত্বনা দিয়েছে। গত ১৫ এপ্রিল আমার আব্বু পরোলকগমন করেন। বটগাছের মতো ছায়া হয়ে থাকা মানুষটি নেই। কিন্তু তার অজস্র স্নেহ-মমতা মাখা হাসি-কান্নার স্মৃতি, দায়িত্ববোধ, আদর্শ রেখে গেছে, যা আমৃত্যু বেঁচে থাকবে আমার হৃদয়ে। বেঁচে থাকবে আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফেরার সেই আকুল মনের প্রতীক্ষার কথা!

ভাল থাকুক পৃথিবীর সকল বাবা!

লেখক: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী 

 

জয়নব/রফিক