‘মা’র পর একটি সন্তানের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং ভরসা তার বাবা। জন্মের পর আমাদের পরিচয় প্রদানকারী আমাদের বাবা। বাবার হাত ধরেই হাঁটতে শেখা, বাবা আছে বলেই নিশ্চিন্তে থাকা। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভরসা আমার বাবা। বাবা এমন একটি ছায়া যে ছায়া র নিচে নিশ্চিন্তে দিন কাটানো যায়।
ছোটবেলায় একবার বাবা ও বোনের সঙ্গে দুর্গাপুজো দেখতে গিয়ে ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমার কত বছর বয়স ছিল, তা মনে নেই । যখন কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তখন মনে হচ্ছিল আমার আশেপাশের পরিবেশ পুরো অচেনা। কারো কথাই কানে আসছিল না। মনে হচ্ছিল, পুরো পৃথিবীটা ওলটপালট হয়ে গেছে । আমি ছুটছিলাম বাবার খোঁজে।
তারপর হঠাৎ একজন লোক এসে আমার হাত ধরেছিলেন, সেও ছিল একজন বাবা। তার এক হাতে আমি আর অন্য হাতে তার মেয়ে ছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার মা-বাবা কোথায়, তুমি একা কেন?’ বললাম, আমি হারিয়ে গেছি। জানি না আমার বাবা কোথায়? তিনি বললেন, ‘তুমি এখানে দাঁড়াও আমার সঙ্গে। তখন একটু পর আমাকে হন্তদন্ত হয়ে খুঁজতে দেখলাম আমার বাবাকে। যখন দেখলাম বাবাকে, তখনই তার কাছে ছুটে চলে যাই। এলোমেলো হয়ে যাওয়া পৃথিবীটা নিমেষেই আবার সাজতে শুরু করে। তখন বাবা ধমক দিয়ে বললেন, ‘কোথায় চলে গেছিলে না বলে?’ তখন আমি বুঝেছিলাম, বাবা না থাকলে জীবনটাই অন্ধকার।
তিনি শুধু পিতা নয়, একটি পরিবারের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শুধু শখ-আহ্লাদই নয় পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব মৌলিক চাহিদা পূরণ করেন বাবা। একজন বাবা শুধু জন্মদাতাই নন, স্বপ্ন গড়ার কারিগরও বটে। কারণ বাবারা পাশে থাকে বলেই আমরা নিজেদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারি। আর সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে বাবা। একজন বাবাই মনে হয় পৃথিবীতে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি নিজের চেয়েও বেশি সন্তানের উন্নতি দেখতে চান।
কিন্তু যখন আমরা বড় হতে থাকি, আত্মনির্ভরশীল হই, তখন নানা কারণে বাবা-মা’র সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। প্রয়োজন না হলে কথাই হয় না, হয় না ছোটবেলার মতো কিছু হলেই জড়িয়ে ধরা। হয়ে ওঠে না সব কথা বলা, হয় না আর হাত ধরে ঘুরতে যাওয়া, বাবার পাশে শোয়ার জন্য বাবার হাতে খাওয়ার জন্য ভাই-বোনের ঝগড়া। সেগুলো শুধু এখন অতীতের স্মৃতি। তবুও রোমন্থন করতে করতে ভালোলাগে।
বাবাকে নিয়ে মনে রাখার মত আরও অনেক স্মৃতি আছে। সেগুলোর মধ্যে একটা অন্যতম হলো- আসলে আমি প্রতিবারই আমার জন্মদিন নিয়ে খুব উত্তেজনাপূর্ণ থাকি। কারণ সেদিনটিতে আমার থেকেও বেশি আনন্দিত থাকে আমার বাবা। তাই প্রত্যেকবার তিনি আমার জন্মদিনে বিশেষ কিছু না কিছু করেনই।
একবার বাবা বলেছিলেন, এবার তিনি আমার জন্মদিন উপলক্ষে কিছুই করবেন না। আমিও চাইনি কিছু হোক। তবে বাবা বলাতে একটু মন খারাপ হলো। যাই হোক আমি যথারীতি সেদিন কলেজে চলে গেলাম। কলেজের পর কোচিং শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি ঘর খুব সুন্দর করে সাজানো। মা খাইয়ে দিলেন, বাবা বাসায় ছিলেন না। কিছুক্ষণ পর বাবা ফোন দিয়ে বললেন, ‘সরি মামনি, সারপ্রাইজটা নষ্ট হয়ে গেল।’ আমি বললাম কিসের সারপ্রাইজ? বাবা বললেন, ‘তুমি এখনও দেখনি?’
তারপর মা আমার জন্মদিনের কেকটা বের করে দেখালেন এবং বললেন, ‘‘তোর বাবা এগুলো সব নিজে করেছে।’ আমি প্রথমে অবাক হলেও খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু বাবার দুঃখ প্রকাশ করার কারণ হলো, তিনি আমার জন্য যে কেকটা এনেছিলেন, সেটার ডিজাইন দুপুরে বাড়ি ফেরার সময় রিকশার সঙ্গে ধাক্কা লেগে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আর সবচেয়ে বড় কারণ হলো, কেকটার ডিজাইন বাবা নিজে পছন্দ করে করিয়েছিলেন।
তবে বাবার মন খারাপ হলেও আমি সবচেয়ে খুশি হয়েছিলাম, আমার প্রতি বাবার ভালোবাসা ও চিন্তা-ভাবনা দেখে। তিনি আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি সত্যি খুব অভিভূত হয়েছিলাম।
সত্যিই, পৃথিবীতে একজন বাবাই হতে পারেন, তার সন্তানকে বিশেষ অনুভব করাতে। একটা মেয়ে যেমনই হোক না কেন, সেটা বাবার কাছে রাজকন্যা রূপেই থাকে সারাজীবন।
মেয়েরা নাকি বাবার প্রতিচ্ছবি। তবে এটা সত্যি যে, এ পৃথিবীতে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তার বাবাকে। তাই বাবার প্রতি অভিমানও সবচেয়ে বেশি হয়। কারো কথা না শুনলেও আমি বাবার কথা ফেলতে পারি না।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিনটি আমার কাছে সবসময় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ সেদিন প্রথম আমার বাবা আমার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গিয়েছিলেন। বাবা আমার থেকেও বেশি উত্তেজনাপূর্ণ ও খুশি ছিলেন। সেদিন ভর্তি কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ১০টায়। কিন্তু আমার বাবা ও আমি সকাল ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। কোথায় আমার ডিপার্টমেন্ট, কোথায় ভর্তি নিবে, কি কাগজপত্র লাগবে, কিভাবে ভর্তি হতে হবে- এসব কাজে আমার থেকে বেশি তার চিন্তা ছিল। এমনকি স্যারদের সঙ্গেও তিনি কথা বলেছিলেন। বরাবরই আমার বাবা সবকিছুতেই বেশি তাড়াহুড়ো করেন।
ভর্তি শেষে বাবার সঙ্গে ক্যান্টিনে নাস্তা করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের জায়গাগুলো রিকশায় করে ঘুরে দেখা এ সবকিছুই বেশ উপভোগ্য ছিল। ওইদিন তার চোখেমুখে যে আনন্দ ও উজ্জ্বলতা দেখতে দেখেছিলাম, সেটা আমার কাছে খুবই অমূল্য। আর আমাকে নিয়ে তার গর্বিত অনুভব করানো জন্য, ওই দিনটা আমার কাছে খুব স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তবে প্রথম দিনের মত এখনো প্রতিদিন ক্যাম্পাসে গেলে কখন ফিরব, পৌছেছি কিনা, কি করছি, কখন ক্লাস, খেয়েছি কি-না, এমনকি এ গরমে জল খাওয়ার কথাও মনে করিয়ে দেন বাবা।
বাবা শব্দটির গভীরতা এতো যে, ব্যক্তিভেদে এর অর্থও ভিন্ন। তবে বাবার প্রতি সবার অনুভূতি এক। আমার কাছে এক আকাশ সমান ভালোবাসার নাম বাবা। তিনি শাসন করলেও আদর মনে হয়।
শত কষ্টের মাঝেও আমাদের ইচ্ছে, প্রয়োজন সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে পূরণ করেন বাবা। জন্মদিন, পরীক্ষা- যেকোনো কিছুতে আমার থেকেও যে মানুষটি সবচেয়ে বেশি উৎসাহী থাকেন, তিনি আমার বাবা। মা যদি হয় অক্সিজেন, তাহলে বাবা হলো ছায়া যে ছায়ার নিচে নিশ্চিন্তে দিন কাটানো যায়।
নিঃস্বার্থভাবে পরিবারের সবার দায়িত্ব নেওয়া, কর্তব্য পালন করা, ধৈর্যশীল হওয়া ইত্যাদি গুণগুলো আমরা বাবার থেকেই শিখেছি।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়