সাতসতেরো

ব্রিটিশবিরোধী নেতা বিপিন পাল হবিগঞ্জের সন্তান

মো. মামুন চৌধুরী, হবিগঞ্জ : ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা স্বাধীনতা সংগ্রামী বাগ্মী নেতা বিপিন চন্দ্র পালের জন্মদিন আজ। ১৮৫৮ সালের ৭ নভেম্বর হবিগঞ্জের পইল গ্রামে জন্ম তার। তাই দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের ও তার স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি হবিগঞ্জবাসীর।

 

এই নেতার জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে সরকারীভাবে হবিগঞ্জে এবারই কোন কর্মসূচী পালিত হচ্ছে। এ ছাড়াও পইল গ্রামে সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও বিপিন চন্দ্র  পাল স্মৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সৈয়দ আহমদুল হক এবং বিপিন চন্দ্র পাল স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।

 

বিপিন পালের পিতা রামচন্দ্র পাল ছিলেন একজন গ্রাম্য জমিদার এবং সিলেট বারের প্রভাবশালী সদস্য। বাবার হাতেই বিপিন চন্দ্র পালের লেখাপড়ার হাতেখড়ি । ১৮৬৬ সালে বিপিন চন্দ্র পালকে তার বাবা নয়া সড়ক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তারপর তিনি সিলেটের প্রাইজ স্কুল, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ে লেখাপড়া করেন। রামচন্দ্র  পাল কোর্টে কয়েক বছর চাকরি করলেও পরে নিজ জেলা সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ চলে আসেন। তারপর সিলেট বারে আইনজীবী হিসেবে যুক্ত হন। একসময় তিনি সিলেটের একজন খ্যাতনামা উকিল হিসেবেও সুনাম কুড়ান।

 

বিপিন চন্দ্র পাল বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহ রোধে এবং নারীশিক্ষার প্রচলনে তৎকালে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিপিন পাল আমৃত্যু লড়েছেন। বিপিন চন্দ্র পালের মাও ছিলেন উদার ও মানবিক গুণের অধিকারী। পারিবারিকভাবেই বিপিন চন্দ্র পালের মধ্যে সাম্য ও মানবতা বোধের দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠে। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৮৭৭ সালে কলকাতায় শ্রীহট্ট সম্মিলনি স্থাপিত হয়। তিনি ১৮৮০ সালে সিলেটের মুফতি স্কুলের ভগ্নাংশ নিয়ে সিলেট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয প্রতিষ্ঠা করে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৮০ সালে  প্রকাশ করেন সিলেটের প্রথম বাংলা সংবাদপত্র পরিদর্শন।

 

এ ছাড়া তিনি বেঙ্গল পাবলিক অপিনিয়ন, ট্রিবিউন, স্বরাজ, হিন্দু রিভিউ, সোনার বাংলা, ইনডিপেনডেন্ট, ডেমোক্রেটসহ অনেক পত্রিকায় সাংবাদিক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

 

তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ছিলেন অখন্ড ভারত আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা। ভারত উপমহাদেশের কংগ্রেসীয় রাজনীতির প্রগতিশীল গ্রুপের তিন দিকপালের তিনি একজন ছিলেন। উপমহাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিপিন পালই একমাত্র বিরল প্রতিভার অধিকারী- যিনি একাধারে রাজনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক ও সমাজ সংস্কারক । তাঁর বাগ্মীতা ছিল অসাধারণ। অনলবর্শী বক্তা হিসেবে তাকে ‘বাগ্মী বিপিন চন্দ্র পাল’ বলে অভিহিত করা হয়।

 

যৌবনের প্রথমদিকে কথাসাহিত্যের ভেতর দিয়ে তার সাহিত্য জীবনে সূচনা হয়েছিল। তার সৃষ্টির মধ্যে প্রবন্ধের সংখ্যা বেশি। তা ছাড়া তিনি উপন্যাস, জীবনী, আত্মজীবনী, ইতিহাস রচনা করেছেন। তার ‘সত্তর বছর’ বইটি সেকালের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের দলিল হিসেবে স্বীকৃত।

 

বিপিন চন্দ্র পালের প্রথম উপন্যাস `শোভনা` প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ সালে। `শোভনা` নারীসমাজের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টির উদ্দেশ্য লিখিত একটি উপন্যাস। পূর্ববাংলার নাগরিকদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন প্রথম উপন্যাস লিখেছেন `রতœবতী`। সেই হিসেবে রতœবতী (১৮৬৯) আমাদের প্রথম উপন্যাস। বিপিন চন্দ্র পালের `শোভনা` (১৮৮৪ বাংলা) উপন্যাসের দ্বিতীয় উপন্যাস। বিপিন চন্দ্র  পালের বাংলায় ১৫ টি এবং ইংরেজিতে ১৭টির বেশী বই লিখেছেন। বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় লিখিত তাঁর ২৫ টিরও বেশি বই বিশ্বের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়। মহাত্মা গান্ধীর কংগ্রেসে যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত দেশের বামপন্থী নেতৃত্ব বিপিন পালের হাতেই ছিল ।

 

রাইজিংবিডি/হবিগঞ্জ/৭ নভেম্বর ২০১৫/মামুন/টিপু