কাঞ্চন কুমারকুষ্টিয়া, ২১ ডিসেম্বর: গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় আর ঐতিহ্যবাহি লাঠিখেলা আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে।
তার পরেও কোন কোন এলাকায় এ খেলাকে টিকিয়ে রাখতে প্রাণপন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এলাকার সমাজসেবী কতিপয় ব্যক্তি। হয়তো বা দেশীয় কৃষ্টি ও সাংস্কৃতি বুকে লালন করার জন্যই এই প্রাণপণ চেষ্টা। এই চেষ্টাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ণে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। তা না হলে ঐতিহ্যবাহি এ লাঠি খেলা অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে।
নানা প্রতিকুলতার মধ্যদিয়ে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের সদরপুর গ্রামের রমজান আলী সাহেবের নের্তৃত্বে সদরপুর লাঠিয়াল বাহিনী নামের একটি ঐতিহ্যবাহি লাঠিয়াল দল খুড়িয়ে খুড়িয়ে তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছে।
লাঠিখেলার শুরু কথা
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের সদরপুর গ্রামের এরফান আলী মন্ডলের ছেলে বিশিষ্ট সমাজ সেবক রমজান আলী সাহেব ১৯৯০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্থানীয় কয়েকজন ছেলেদের নিয়ে একটি লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করে। বংশানুক্রমে তার পরিবার গত ১শত বছর ধরে এ লাঠিখেলা লালন করে চলেছে। তবে ১৯৯০ সাল থেকে তার প্রচেষ্টায় আধুনিক লাঠিখেলা শুরু হয়। বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মরহুম সিরাজুল হক চৌধুরী (ওস্তাদ ভাই) জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত তার সুযোগ্য ছোট ছেলে বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর সেক্রেটারী প্রয়াত মঞ্জুরুল হক চৌধুরী (চক্রমনি) রতনের সহযোগীতায় এ লাঠিখেলা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সদরপুরে লাঠিয়াল বাহিনী শুরুর দিকে স্থানীয় ভাবে জাসদ নেতা প্রয়াত বসির উদ্দিন কচি এবং আমলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রকৌশলী হুমায়ুন কবিরের অনুপ্রেরণায় আমলা পানি উন্নয়ন বোর্ড চত্বরে প্রদশর্নী খেলার মাধ্যমে রমজান আলী সাহেব এ দলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেন। দল গঠিত হওয়ার পর থেকে সদরপুর লাঠিয়াল দলকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তারা একের পর এক জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে লাঠিখেলা প্রদর্শন করে ছিনিয়ে এনেছে অনেক পুরস্কার ও খ্যাতি।
প্রতি বছর বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর কেন্দ্রীয় দফতরে শিক্ষা শিবির অনুষ্ঠিত হয়। এতে এক সময়ের খ্যাতি সম্পন্ন মার্শাল আর্টের ইউরিসহ সহস্রাধিক লাঠিয়াল বাহিনী অংশ নেয়। এর মধ্যে প্রায় প্রতি বছরই এ শিক্ষা শিবির থেকে শ্রেষ্ঠ এবং বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ দল হিসেবে সদরপুর লাঠিয়াল বাহিনী স্বীকৃতি লাভ করে দলের পুরস্কার ছিনিয়ে আনে।
পরবর্তিতে ১৯৯৪ সালে জাতীয় স্টেডিয়ামে ৬ষ্ঠ সাফ গেমসের সমাপনী অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ৭০টি লাঠিয়াল দলের ১৫ শত লাঠিয়াল অংশ নেয়। ঐ অনুষ্ঠানের শ্রেয়মনি কমিটির চেয়ারম্যান অবঃ মেজর জেনারেল আমিন আহম্মেদ চৌধুরী সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য অনুষ্ঠানে সদরপুর লাঠিয়াল বাহিনী অংশ গ্রহন করে। এতে আবার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানিত হয় এবং জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। পর্যায়ক্রমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসসহ সরকারের উচ্চ পদস্থ মন্ত্রীদের অনুষ্ঠানে সদরপুর লাঠিয়াল বাহিনী অংশ নেয়। তৎকালীন এলজিইডি প্রতিষ্ঠাতা প্রধান প্রকৌশলী প্রয়াত কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর আমন্ত্রনে এ দলটি বেশ কয়েকটি স্থানে অংশ নিয়ে পুরস্কার লাভ করে।
পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে জাতীয় স্টেডিয়াম, আউটার স্টেডিয়াম এবং মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামেও তারা অংশ নেয়। কুষ্টিয়ার বিশিষ্ট শিল্পপতি আলাউদ্দিন আহম্মেদের আমন্ত্রণে এ দলটি চড়াইকোলের আলাউদ্দিন নগরে অংশগ্রহণ করে এবং পুরস্কার ছিনিয়ে আনে।
১৯৯৭ সালের দিকে শেখ হাসিনাসহ তৎকালীন রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে এ দল অংশ নেয়। ১৯৯৮ সময়ে তৎকালীন সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আমন্ত্রণে নিখিলবঙ্গ উদযাপন সমিতির আয়োজনে কলিকাতা যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন এবং নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতিবসু ও রাজ্যপাল বিরেন জে শাহ’র আমন্ত্রণে এ লাঠিয়াল বাহিনী অংশ নেয়। এতে নেতৃত্ব দেন মঞ্জুরুল হক চৌধুরী রতন ও রমজান আলী সাহেব। এ বাহিনীতে ৫০ জন লাঠিয়াল অংশ নেন।
এছাড়া ৭/৮ বার ঢাকায় সেগুন বাগিচায় অবস্থিত কচিকাঁচার মেলায় এবং নড়াইলের বরেণ্য চিত্রশিল্পী সুলতান মেলায় সদরপুর লাঠিয়াল বাহিনী কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে। এছাড়া এ লাঠিয়াল বাহিনীর চিত্র ধারন করে বিভিন্ন দেশী বিদেশী স্যাটেলাইট চ্যানেল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চ্যানেল এটিএন বাংলা, এনটিভি ও বিদেশী বান সোসাইটির সভাপতি, আমেরিকা, ব্রিটেন ও চিনের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সময় মিরপুর উপজেলার সদরপুরে এসে লাঠিয়াল বাহিনীর লাঠিখেলার চিত্র ধারন করে তারা।
জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে প্রবেশ
৬ষ্ঠ সাফ গেমসে অংশ নেওয়াসহ বিভিন্ন সময়ে সদরপুর লাঠিয়াল বাহিনী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লাঠিখেলা প্রদর্শন করেছে। দেশের মধ্যে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, নড়াইল,ফরিদপুর, রাজবাড়ি, রাজশাহী,কুমিল্লা, রংপুর,টাঙ্গাইলে লাঠিখেলা প্রদর্শন করেছে।
এছাড়া দেশের বাইরে কলিকাতায় অংশ গ্রহন করেন এই খেলোয়াড়েরা। পরে সদরপুর লাঠিয়াল বাহিনী রংপুর ও টাঙ্গাইলে নির্মিত তেভাগা আন্দোলন নিয়ে নির্মিত বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার সাইদুল আনাম টুটুল কর্তৃক নির্মিত আধিয়ার চলচিত্রে ১শত জন লাঠিয়াল নিয়ে বাহিনীর অধিনায়ক রমজান আলী সাহেব অংশ গ্রহন করেন। এই চলচ্চিত্রটি আর্ন্তজাতিক খ্যাতি লাভ ও সরকারী পুরস্কার লাভ করেন।
সদরপুর লাঠিয়াল বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রমজান আলী সাহেবকে তার এ লাঠিয়াল বাহিনী সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, মিরপুর উপজেলা প্যারী সুন্দরী মঞ্চে ১২টি লাঠিয়াল দলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে সদরপুর লাঠিয়াল দল। তারপর কুষ্টিয়া শিল্পকলা একাডেমি চত্তরে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে সদরপুর লাঠিয়াল বাহিনী অংশ গ্রহন করে।
তিনি আরো বলেন, বহু কষ্ট ও পরিশ্রম করে এ লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করেছি। লাঠিয়াল দলের সদস্যরা সবই প্রায় দরিদ্র পরিবারের সদস্য। দারিদ্রতার মাঝেও এদের সংগঠিত করে উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে বৃহত্তর কুষ্টিয়াসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি শ্রেষ্ঠ লাঠিয়াল দল তৈরী করতে পেরে আমি গর্বিত। তবে এ খেলাটিকে ধরে রাখতে হলে সরকারের সরকারী সাহায্য-সহযোগীতা প্রয়োজন। তা না হলে অচিরেই দেশ থেকে লাঠিখেলার মত গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহি একটি সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
রাইজিংবিডি/ কাঞ্চন কুমার / লিমন