সাতসতেরো

‘ক্যামনে চইলতাম’

জীবন আগে না জীবিকা? নিঃসন্দেহে জীবন আগে। কিন্তু জীবনের প্রয়োজনেই তো মানুষকে যে কোনো জীবিকা বেছে নিতে হয়। এই মহামারি যেন মানুষের জীবন এবং জীবিকাকে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে। নতুন করে তৈরি হয়েছে সংশয়। 

পেটে খাবার জুটলেই কেবল বেঁচে থাকা সম্ভব। বিপরীতে এই আহারের জন্যই মানুষকে ঘরের বাইরে বের হতে হচ্ছে। অথচ এ সময় বাইরে যাওয়া মানেই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি এই উভয়মুখী সংকটে পড়েছেন দেশের দিনমজুর, খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত অসহায় মানুষ। 

লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার বলিরপোল বাজারে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন খবিরুল ইসলাম। যখন এ প্রসঙ্গে তার কাছে জানতে চাইলাম কণ্ঠে ধরা পড়ল স্পষ্ট অসহায়ত্ব। সামলে নিয়ে বললেন, ‘অন্য টাইম অইলে এতক্কন তিন-চাইরশ টিঁয়া কামাই অঁই যাইতো। অন দ্যাখেন, মাত্র হত্তোর টিঁয়ার রিকশা চালাইছি।’

বুঝতে পারলাম তিনি কী বলতে চাইছেন। উপার্জন কমে গেছে, ফলে রিকশা চালানোর সময় কমিয়ে দিয়ে ঘরে থাকবেন সে উপায় নেই। একই কথা বললেন, সিএনজি অটোরিকশা চালক আবদুল কালাম। ‘করোনা আইয়্যনের হরেরত্তন একদিনও রাস্তাই গাড়ি লই বাইর হই নাই। আইজ্জাই বাইর অইছি। হাওলাত-বরাত করন লাইগছে। ক্যামনে চইলতাম?’

এই প্রশ্ন আজ সবার মনে। কীভাবে কাটবে সামনের দিনগুলো- কেউ জানে না! সিরাজ যাত্রীর অপেক্ষায় অটোরিকশা নিয়ে পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। কথোপকথনের বিষয় শুনে নিজে থেকেই বললেন, ‘জীবন বড় কিন্তু আয়-রোজগার আগে। লকডাউন দেওনের হরেত্তন গাড়ি লই তেমন বাইর অই ন। না পাইরতে বাইর অইছি। সাতজনের সংসার। খুব কষ্টে আছি- বলার মতো না!’

বলিরপোলের সিএনজি স্টেশনের চা-দোকানি কামাল হোসেন। বাড়িতে মা, স্ত্রী-ছেলেমেয়ে আছে। ভরা সংসার। কীভাবে চলছে? জানতে চেয়েছিলাম তার কাছে। কামালের স্পষ্ট জবাব, ‘দুই মাস লকডাউনের সময় দোয়ান খুলি ন। ঘরের দুয়ারে চেয়ার টানি নিয়া বসি থাকতাম। ধার-দেনা করে চইলছি। ৩০ হাজার টিঁয়া দেনা কইচ্চি। বাইত হুতি থাইকলে রোগ ছুঁইতে পারে না, কিন্তু প্যাট তো চলে না।’

উত্তর খুব সহজ- জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। অথচ এই জীবনই সমাজের খেটে খাওয়া মানুষকে ফেলেছে সংকটে। জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও তারা ঘর থেকে বের হচ্ছেন জীবনেরই প্রয়োজনে। সিএনজি অটোরিকশা চালক লিটনের মতে ‘জীবন এবং জীবিকা দুইটাই এখন মুখোমুখী।’

বলিরপোল বাজারের ওষুধ বিক্রেতা এবং পল্লী চিকিৎসক খুরশিদ আলমের মতে জীবন এবং জীবিকা পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘অযথা অনেক লোক এখনও বাজারে এসে আড্ডা দেয়। এটা এদের অভ্যাস! সারা জীবন বাজারে আসতো, এখনও আসে। এলাকার অনেকে আবার লকডাউনের অবসরে বাড়ি-ঘর ঠিক করে নিচ্ছে।’ বাজারের ঢেউ টিনের দোকানে গ্রাহকের ভিড় দেখিয়ে তিনি কথার স্বপক্ষে প্রমাণও দেখালেন। কিন্তু সব শেষে খুরশিদ আলম যা বললেন এই করোনাকালে সেটাই চরম বাস্তবতা। ‘সমস্যা তো গরিবের। একদল মানুষের হাতে মাস্ক কেনার টাকা নাই। অন্য একদল ঢেউ টিন কিনছে! জীবন উভয়ের কাছেই বড় কিন্তু প্রয়োজন ভিন্ন।’

 

ঢাকা/তারা