সাতসতেরো

জাকিরুল যেভাবে ভাইরাল ‘জ্যাকি ভাই’

জাকিরুল ইসলাম। বয়স ৩৭ ছুঁয়েছে। যদিও এই নামে তিনি খুব বেশি পরিচিত নন। ‘জ্যাকি ভাই’ নামের আড়ালে চাপা পড়েছে বাবা-মা’র দেওয়া নাম। তিনি জনপ্রিয় ইউটিউবার। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় তার অসংখ্য ভক্ত। মাত্র দুই বছরে জাকিরুল ইসলামের এই জনপ্রিয়তা নিয়ে যেমন আলোচনা আছে, তেমনি সমালোচনাও কম নেই। যদিও তাকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যকারীদের তিনি ‘ঈর্ষান্বিত’ বলেই মনে করেন।  

পাবনার ফরিদপুর উপজেলার বিএল বাড়ি ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের আলহাজ্ব আব্দুস সামাদ সরদার ও সালেহা বেগম দম্পতির সন্তান জাকিরুল। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। আল্লাহবাদ হাইস্কুল থেকে ৭ম শ্রেণী পাস করার পর অর্থসংকটে লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে। জীবিকার তাগিদে এক পর্যায়ে শুরু করেন ছোটখাটো মুদি ব্যবসা। ১০ বছরেও ব্যবসা আশানুরূপ সফল না-হওয়ায় বন্ধ করে দেন মুদি দোকান। এরপরই তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন ভার্চুয়াল দুনিয়া সম্পর্কে।

হঠাৎ করে ইউটিউব থেকে আয়ের চিন্তা কীভাবে মাথায় এলো? জানতে চাইলে জাকিরুল বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই গান, অভিনয়, নাটক পছন্দ করতাম। অভিনয় করবো, অভিনেতা হবো- এমন সুপ্ত বাসনা ছিল। সিডি প্লেয়ার যখন ছিল, তখন নিজে গান গেয়ে, অভিনয় করে কয়েকটি ডিস্ক তৈরি করেছিলাম। কিন্তু মন ভরছিল না। উল্টো ঋণগ্রস্ত হলাম। তখন অনেকেই পরামর্শ দিলেন হিরো আলম ভিডিও বানিয়ে জনপ্রিয় হয়েছে, টাকা উপার্জন করেছে- তুমিও করতে পারো। ভেবে দেখলাম, অভিনেতা মোশাররফ করিমের চেহারার সঙ্গে আমার চেহারার মিল রয়েছে, সুতরাং চেষ্টা করতে দোষ কী?’  

সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে জাকিরুল ঢাকা আসেন। অভিনয়ের সুযোগ পেতে ঘুরতে থাকেন দ্বারে দ্বারে। কিন্তু সব জায়গা থেকে বিফল হওয়ার পর হঠাৎ করেই যেন তার সামনে খুলে যায় অন্য এক দুনিয়ার দরজা। এবার জাকিরুল সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নিজেই ভিডিও তৈরি করবেন, হবেন  ইউটিউবার।

‘দুই বছর আগে আমি ইউটিউব চ্যানেলের কাজ শুরু করি। অনেকে বলেছিলেন ইউটিউব থেকে উপার্জন করতে দুই-চার বছর সময় লাগে। আমি বলেছিলাম, ছয় মাস দেখবো, যদি পারি তাহলে এ লাইনে থাকবো, নইলে অন্য পথে যাবো। কিন্তু আমি মাত্র ৩ মাসের মধ্যেই ইউটিউব থেকে উপার্জন করেছি।’

কথোপকথনের এই পর্যায়ে জাকিরুলের চোখ দুটো উজ্জ্বল দেখায়। উৎসাহে যেন টগবগ করে ফুটছেন। নিজেই বললেন, ‘সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা আয় করেছি ইউটিউব থেকে। এখন প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা আয় হয়। দুই মাস আগে ফেসবুক পেজও চালু করেছি।’

জাকিরুলের জীবিকার প্রধান মাধ্যম এখন ভার্চুয়াল দুনিয়া। ইউটিউব তার ধ্যান-জ্ঞান। কন্টেন্টগুলো কীভাবে তৈরি করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমে মানুষের সঙ্গে কথা বলে তার জীবনের গল্প শুনি। অনেকের জীবনে করুণ, নির্মম, আবার কারো জীবনে হতাশা বা না-পাওয়ার গল্প থাকে। আমি জীবনসংশ্লিষ্ট ওই গল্পগুলো নিজের মতো করে উপস্থাপন করি। যার জীবনের গল্প তাকে দিয়েই অভিনয় করানোর চেষ্টা করি যাতে মানুষের মনে দাগ কাটে।’

কিন্তু অভিযোগ রয়েছে গল্পগুলো অনেক সময় অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়। মেশানো হয় সত্য-মিথ্যার প্রলেপ। এ প্রসঙ্গে জাকিরুলের জবাব, ‘আমার প্রতিটি ভিডিও সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি করা। দর্শকদের আকৃষ্ট করতে একটু বাড়তি কিছু যোগ করতে হয়, না-হলে দর্শক দেখবে না। আমারও যে প্রতিভা আছে সেটিও তো দর্শকদের বোঝাতে হবে।’

জাকিরুল মনে করেন নীতি বা নৈতিকতার জায়গায় তিনি ঠিক আছেন। অতিরঞ্জিত বা ফেক ভিডিও তৈরি করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন কি না জানতে চাইলে এই ইউটিউবার বলেন, ‘আমি ফেক ভিডিও তৈরি করি না। আমার করা ভিডিওগুলোতে মানুষ যদি তার জীবনের মিল খুঁজে পায়, ভিডিওগুলো সত্য মনে করে তাহলেই আমার সাফল্য। প্রতারণা তখন হতো যদি আমি বলতাম, আল্লাহর কসম আমার ভিডিওতে সবই সত্যি। আমি তা বলি না। তাছাড়া মানুষ দেখে যদি বুঝতো- এগুলো বানানো কাহিনি, তাহলে প্রতারণা হতো। এখানে একটি বিষয় হচ্ছে, কিছু ইউটিউবার আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। আমার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

আপনি অসহায় মানুষের গল্প ইউটিউবে তুলে ধরেন। এগুলোর সামাজিক প্রতিক্রিয়া কেমন? এই প্রশ্নের জবাবে জাকিরুল বলেন, ‘আমার অনেক ভিডিও দেখে মানুষ সেই অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে সহযোগিতাও এসেছে দুস্থ মানুষের জন্য। আমি এগুলোকে আমার কাজের স্বীকৃতি মনে করি।’  

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে জাকিরুল ইসলাম ওরফে জ্যাকি ভাই বলেন, ‘আমার ঋণগুলো শোধ হয়ে গেলে এলাকায় একটি এতিমখানা বা একটি প্রতিবন্ধী স্কুল করতে চাই। আমি সবসময় অসহায় মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চাই।’