সাতসতেরো

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ৮৬তম জন্মদিন

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় দুই বাংলার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। তিনি গল্প উপন্যাস অদ্ভুতুড়ে সিরিজ- সবই এতো প্রচুর লিখেছেন যে, শীর্ষেন্দু নামটি বই পোকাদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে।

এই কথাসাহিত্যিকের ৮৬তম জন্মদিন আজ। তার জন্ম ১৯৩৫ সালের ২ নভেম্বর বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। তার জীবনের প্রথম এগারো বছর কাটে বাংলাদেশে। ভারত বিভাজনের সময়, তার পরিবার কলকাতা চলে আসে। এই সময় রেলওয়েতে চাকরিরত বাবার সঙ্গে তিনি অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে তার জীবন অতিবাহিত করেন।

জন্মসূত্রে কারণেই হয়তো বাংলাদেশের প্রতি তার নারীর টান। বাংলা একাডেমি আয়োজিত ঢাকা লিট ফেস্টে যোগ দিতে এসে এক সাক্ষাৎকারে সে কথা তিনি নিজের মুখেই প্রকাশ করেন।  

সাক্ষাৎকারে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ঢাকা তো আমার দেশ।  এখানে আমাকে অতিথি হয়ে আসতে হয়, এটাই দুঃখের বিষয়। আমার দেশ তো ঢাকা। আমি বাঙাল। এখনো আমাদের বাড়িতে বাঙাল ভাষায় কথা হয়। আমার স্ত্রীর সাথে, ছেলের সাথে—একেবারে বাঙাল ভাষায় কথা বলি। সুতরাং এখনো আমার ভেতরে বাংলাদেশ। তোমরা যাকে বাংলাদেশ বলো, সেই বাংলা ঢুকে আছে। এখনো মনে হয়, এটাই আমার দেশ। বিদেশে এসেছি তো মনে হয় না। মনে হয় হোম কামিং। এখন তো সেই হোম নেই।  কিছুই তো নেই এখন আর। তবু মনে করি, বাংলাদেশে একটা আশ্রয় আছে। অন্তত ঘর বাড়ি না থাক। আমার মানসিক আশ্রয় তো আছে।’

নিজের লেখক জীবন সম্পর্কে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আমার লেখার কোনো ছক নেই।  পরিকল্পনা নেই।  আমার লেখার ধরন অদ্ভুত।  লিখতে বসার আগ পর্যন্ত জানি না কী লিখব।  তা ছাড়া আমি পাঠকের জন্য নয়, নিজের জন্যই লিখি।  যতক্ষণ নিজে সন্তুষ্ট হতে পারি না ততক্ষণ স্বস্তি আসে না।  নিজের লেখা পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত আমি চেষ্টা করে যাই।  আমার মধ্যে অন্যমনষ্কতা কাজ করে। অনেক সময় মনেও থাকে না আমি একজন লেখক।’

সামান্য স্কুল শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবনের পথ চলা শুরু। বর্তমানে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত।  তিনি নবীন থেকে প্রবীণ সকল বয়সীদের কাছে তার লেখনীর মাধ্যমে জনপ্রিয়। 

‘দূরবীণ’ তার একটি জনপ্রিয় উপন্যাস। এর নায়ক ধ্রুবকে চিত্রায়িত করেছেন কাপুরুষ হিসেবে।  অথচ তাকে সবাই ভালোবাসে।  তার উপন্যাসের সুবাদে ধ্রুব গেঁথে রয়েছে অনেক পাঠকের মনে। 

তিনি প্রচুর উপন্যাস লিখেছেন। তার প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে-

যাও পাখি, উজান, কাগজের বউ, কীট, ক্ষয়, চোখ, জাল, দিন যায়, পারাপার, ফুলচোর, বিকেলের মৃত্যু, মানবজমিন, ঘুণপোকা, আশ্চর্য ভ্রমণ, রঙীন সাঁকো, পাপ, তিন হাজার দুই, নয়নশ্যামা, হৃদয়বৃত্তান্ত, নানা রঙের আলো, গয়নার বাক্স, অসুখের পরে, গতি, প্রজাপতির মৃত্যু ও পুর্নজন্ম, দ্বিতীয় সত্তার সন্ধানে, আদম ইভ ও অন্ধকার, নিচের লোক উপরের লোক, ক্রীড়াভূমি, সম্পত্তি, তিথি, পার্থিব, চক্র, আলোয় ছায়ায়, আলোর গল্প ছায়ার গল্প, ঋণ, কাপুরুষ, কালো বেড়াল সাদা বেড়াল, গুহামানব, দ্বিচারিনী, নীলু হাজরার হত্যা রহস্য, পিদিমের আলো, ফজল আলি আসছে, মাধব ও তার পারিপার্শ্বিক, লাল নীল মানুষ, শ্যাওলা, শিউলির গন্ধ, সাঁতারু ও জলকন্যা, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে, ছায়াময়, দৃশ্যাবলী, বোধন ও বিসর্জন, এই সব পাপটাপ, হাটবার, চেনা অচেনা, যুগলবন্দী, সেই আমি, বাসস্টপে কেউ নেই, কাছের মানুষ, হরিপুরের হরেককান্ড, বাঙালের আমেরিকা দর্শন, একাদশীর ভূত, ওয়ারিশ, চারদিক, গোলমাল, আক্রান্ত, ফেরীঘাট, মাধুর জন্য, জোড়বিজোড়, বড়সাহেব, নেকলেস, নরনারী কথা, খুদকুঁড়ো ইত্যাদি।

উপন্যাসের সংখ্যা যেমন, অদ্ভুতুড়ে সিরিজের সংখ্যা তেমন আবার গল্পের বইয়ের সংখ্যাও প্রচুর। যেন দু'হাতে অবিরাম লিখে চলেছেন তিনি। 

তার প্রথম গল্প জলতরঙ্গ শিরোনামে ১৯৫৯ সালে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাত বছর পরে ওই একই পত্রিকার পূজাবার্ষিকীতে ঘুণপোকা নামক তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। ছোটদের জন্য লেখা তার প্রথম উপন্যাস মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি। শবর দাশগুপ্ত তার সৃষ্ট অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র। লেখক হিসেবে যে আকাশ ছোঁয়া সাফল্য পেয়েছেন, তা বিস্ময়ের।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বহু উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে।  তার সৃষ্ট শবর চরিত্রটি নিয়ে তৈরি হয়েছে তিনটি রহস্য চলচ্চিত্র।  এছাড়াও অদ্ভুতুড়ে সিরিজ অবলম্বনে বিভিন্ন সিনেমা তৈরি হয়েছে।  এসব চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে-

আজব গাঁয়ের আজব কথা, বাঁশিওয়ালা, পাতালঘর, গোঁসাইবাগানের ভূত, দোসর, কাগজের বৌ, গয়নার বাক্স, ছায়াময়, সাধুবাবার লাঠি, মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, ঈগলের চোখ, আসছে আবার শবর, হীরের আংটি, আশ্চর্য প্রদীপ, এবার শবর ইত্যাদি।

শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৫ সালে বিদ্যাসাগর পুরস্কার পান।  আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার (১৯৭৩ ও ১৯৯০)।  ২০১২ সালে পেয়েছেন বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার।  এছাড়া মানবজমিন উপন্যাসের জন্য ১৯৮৮ সালে পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার।