ভোরে সুনামগঞ্জ শহরে নতুন ব্রিজে নেমে মোটরসাইকেলে টাঙ্গুয়ার হাওরে চলে এলাম। ‘হাওর বিলাস’ রিসোর্টে মালপত্র রেখে সাদ্দামের নৌকায় রোয়ার খাল পার হয়ে লেইচ্ছামারা খালের দিকে রওয়ানা হলাম। দিনটি ছিল ২০২০ সালের ৮ মার্চ। বেশ গরম পড়েছিল। এরই মধ্যে নতুন এবং একটি বিরল প্রজাতির পাখির সন্ধানে লেইচ্ছামারা খাল তন্নতন্ন করে খুঁজছিলাম। কোথাও পাখিটির দেখা পেলাম না। অন্যান্য প্রজাতির পাখির ছবি তুলে দুপুরে হাওর বিলাসে ফিরে আসি।
দুপুরের খাবার খেয়ে পুনরায় নৌকা নিয়ে বের হলাম। রোয়ার খালের শেষ মাথায় বাঁ দিকে মরাখালে নৌকা নিয়ে সামনের দিকে যাচ্ছি। মেটে মাথা হাঁসগুলো তখনও পানিতে ভাসছিল। ইঞ্জিন বোটের শব্দে হাঁসপাখিগুলো উড়ে গেল। পড়ন্ত বিকাল। সূর্যের তাপের তীব্রতাও কমে গেছে। মরাখালের দুইপাশ অরণ্যে ঢাকা। চারদিকে সবুজের সমাহার। প্রথম দর্শনেই যে কারো মন কেড়ে নেবে। নৌকায় কিছুটা পথ যাওয়ার পর হঠাৎ নজরে পড়লো খালের পাড়ে কি যেন হেঁটে চলে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা তাক করে মাত্র দুটি ছবি তুললাম। নতুন আরেকটি পাখির ছবি আমার ভাণ্ডারে যুক্ত হলো।
যে পাখিটি নিয়ে কথা বলছিলাম সেটি হলো আমাদের দেশীয় পাখি জল মোরগ বা কোড়া। এটি Gallicrex বংশীয় ৪৩-৪৫ সেমি দৈর্ঘ্যের Rallidae পরিবারের জলচর পাখি। আমাদের দেশের গ্রামের মানুষের কাছে অতি প্রিয় ও পরিচিত দেশীয় পাখি। এক সময় মানুষ নির্বিচারে জল মোরগ ফাঁদ পেতে শিকার করতো। বর্তমানে এদের শিকার করা বহুলাংশে কমেছে। ছেলে ও মেয়েপাখির চেহেরায় ভিন্নতা রয়েছে। প্রজননকালে ছেলেপাখির পুরো দেহ ধূসরাভ-কালো রং ধারণ করে। মাথার চাঁদিতে লাল বর্ম খাড়া হয়ে ওঠে। যা মেয়েপাখিকে আকর্ষণ করে। চোখ লাল রঙের হয়। ঠোঁট, পা ও পায়ের পাতা লালচে হয়। লেজ-ঢাকনিতে কালো ডোরা থাক। প্রজননকাল ছাড়া ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা একই রকমের হয়ে যায়। চোখ ও ঠোঁট হলুদ বা হলদে হয়।
জল মোরগ বাংলাদেশের ধান ক্ষেত, হাওর ও বিলে বিচরণ করে। এ ছাড়াও আদ্র বনভূমি বা ঘাসবন ও আবাদি জমি এলাকায় দেখা যায়। সচারচর একা থাকে। মাঝে মাঝে জোড়ায় থাকে। মাটিতে বা ভাসমান জলজ উদ্ভিদে হেঁটে হেঁটে খাবার খায়। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে জলজ উদ্ভিদের বীজ ও অঙ্কুর। এছাড়াও ধান, শামুক-জাতীয় প্রাণী, কেঁচো ও জলজ পোকা খেয়ে থাকে।
বৃষ্টির দিন বা মেঘলা দিনে এদের কর্মচঞ্চলতা বেশি দেখা যায়। পুরুষ জল মোরগ এলাকায় প্রাধান্য বিস্তারের জন্য বাঘের মতো সীমানা নির্ধারণ করে নেয়। নিজেদের নির্ধারিত সীমানায় অন্য কোনো জল মোরগের উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না। তাই ছেলেপাখিদের মধ্যে লড়াই হয়। জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এদের প্রজননকাল। প্রজননকালে পুরুষপাখিদের মধ্যে মেয়েপাখিদের আকর্ষণের জন্য ডাকাডাকির প্রতিযোগিতা চলে। তখন তাদের গলার স্বর গম্ভীর হয়। নলবনে বা ভাসমান ধান গাছে ঘাস-পাতা দিয়ে বাটির মতো বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়েপাখি ৪-৬টি ডিম পাড়ে।
জল মোরগ বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। বরিশাল, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের জলভূমিতে পাওয়া যায়। কিছু অসাধু লোক জল মোরগের ডিম চুরি করে নিয়ে যায়। যে কারণে দিন দিন এদের বংশবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় এই পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।