সাতসতেরো

গণমানুষের নেতা কমরেড মণি সিংহের জন্মদিন আজ

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ এবং গণমানুষের নেতা কমরেড মণি সিংহের ১২১তম জন্মদিন আজ। তিনি সারাজীবন তিনি লড়াই করে গেছেন এদেশের খেটে খাওয়া-মেহনতী মানুষের জন্য।

তিনি এ উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনেরও পুরোধা। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সৈনিক এই আজীবন বিপ্লবী কমরেড। মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারেরও উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।

মুক্তি সংগ্রামের এই কিংবদন্তি নেতার জন্ম ১৯০১ সালের ২৮ জুলাই কলকাতায়। বাবা কালী কুমার সিংহ’র মৃত্যু হলে, মা সরলা দেবী সাত বছরের মণিকে নিয়ে নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে চলে আসেন। এখানে সরলা দেবী তার ভাইদের জমিদারির অংশীদার হয়ে বসবাস শুরু করেন।

স্কুল জীবনেই মণি সিংহ’র মাঝে বিপ্লবের স্ফুরণ ঘটে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ‘অনুশীলন’ দলে যোগ দিয়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে স্থান করে নেন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনের বিপুল গণজাগরণ তরুণ মণি সিংহের মনে গভীর রেখাপাত করে। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করতে নিজেকে মনোনিবেশ করেন। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। ১৯২৫ সালে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে আদর্শরূপে গ্রহণ করেন। ১৯২৮ সাল থেকে কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিজেকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে উৎসর্গ করেন।

১৯৩০ সালের ৯ মে গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৫ সালে জেল থেকে মুক্তি দিলেও নিজ গ্রাম সুসং দুর্গাপুরে তাকে অন্তরীণ করে রাখা হয়। এ সময় কৃষক-খেতমজুরদের পক্ষ নিলে নিজ মামাদের জমিদার পরিবারের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হয়। পাটের ন্যায্য মূল্য দাবি করে কৃষকদের পক্ষে ভাষণ দিলে তার দেড় বছরের জেল হয়।

১৯৩৭ সালে জেল থেকে বেরিয়ে এসে দুর্গাপুরের মুসলমান কৃষক ও গাড়ো হাজংদের পক্ষে ‘টংক প্রথা’র বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এরপর মণি সিংহ টংক আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। ১৯৪১ সালে আবার গ্রেপ্তার হন। ১৫ দিন আটক রাখা হয়। ছাড়া পেয়ে আত্মগোপনে চলে যান।

টংক আন্দোলন হচ্ছে, বাংলার কৃষকদের অধিকার আদায়ের একটি অন্যতম আন্দোলন। যে আন্দোলনের শুরু ১৯৩৭ সালে, শেষ হয় ১৯৫০ সালে। টংক প্রথা হলো উৎপন্ন ফসল দ্বারা জমিদারদের খাজনা পরিশোধ করা। আর তা ছিল টাকা দিয়ে খাজনা পরিশোধের চেয়ে বেশি।

১৯৪৪ সালে সারা বাংলার কৃষাণ সভার প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে তিনি নেত্রকোনায় নিখিল ভারত কৃষাণ সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে গিয়ে তাকে অসংখ্যবার জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে।

১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালেও একই পদে পুনরায় নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে জেলে থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের চাপে অন্যান্য রাজবন্দীর সঙ্গে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। এ বছরের জুলাইতে আবার গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় অনেক নেতাকে মুক্তি দিলেও, ইয়াহিয়া সরকার মণি সিংহকে মুক্তি দেয়নি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বন্দীরা রাজশাহীর জেল ভেঙ্গে তাকে মুক্ত করেন। তিনি ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী গড়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে তাকে নির্বাচিত করা হয়। স্বাধীনতার পর ’৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেস এবং ’৮০ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় কংগ্রেসে মণি সিংহ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৮৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ’৭৭ সালে ৭৭ বছরের মণি সিংহ আবার গ্রেপ্তার হন। জিয়ার শাসনামলে তাকে ছয় মাস কারাগারে অন্তরীণ থাকতে হয়। ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি সক্রিয়ভাবে পার্টির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৯০ সালের শেষদিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর তার জীবনাবসান হয়।

জাতীয় জীবনে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরনোত্তর) ভূষিত হন। কমরেড মণি সিংহ ছিলেন সততা, সাহস, আত্মত্যাগ, মানবপ্রেম, গরীব-দুঃখী শোষিত-নির্যাতিত মেহনতি মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, গভীর দেশপ্রেম এর মূর্ত প্রতীক।