গাঢ় অন্ধকারেও কিছু মানুষ আমাদের আলোর সন্ধান দিয়ে মুক্তির পথ দেখান। অবিশ্বাস, স্বার্থপরতার জোয়ারের মধ্যেও আশার আলো সঞ্চার করেন। তুলসী গৌড়া তেমনই একজন।
ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের হান্নালী গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব এই নারী ‘গাছের মা’ বলে পরিচিত। তাকে গাছের এনসাইক্লোপিডিয়া বলেও আখ্যায়িত করা হয়। কারণ কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী ছাড়াই গাছগাছালির খুঁটিনাটি সম্পর্কে তার রয়েছে অগাধ জ্ঞান।
যেখানে বিশ্বের পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন হচ্ছে। বিশ্বের বাঘা বাঘা সব নেতা ও বিজ্ঞানীরা মরিয়া হয়ে এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার পথ খুঁজছেন সেখানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা তুলসী গৌড়া কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করলেন কীভাবে পরিবেশ বাঁচাতে হবে। নিজ হাতে তিনি ৩০ হাজারেরও বেশি গাছ রোপণ করেছেন। শুধু গাছ রোপণ করেই তিনি থামেননি, মায়ের মতো সন্তানস্বরূপ গাছগুলোকে বড় করেছেন।
কর্ণাটকের হালাক্কি সম্প্রদায়ভুক্ত ৭২ বছর বয়সী তুলসী গৌড়া বরাবরই প্রকৃতিপ্রেমী। কিশোরী বয়স থেকেই তিনি বৃক্ষ রোপণ শুরু করেন। এরপর ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি বৃক্ষ রোপণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ করে চলেছেন। এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চলতি বছর ভারত সরকার তাকে মর্যদাপূর্ণ পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত করেছেন।
১২ বছর বয়সেই তুলসী গৌড়া বন অধিদফতরের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার মা বন অধিদফতরের দৈনিক হাজিরা ভিত্তিক কর্মী ছিলেন। খুব অল্প বয়সে তুলসী বাবাকে হারান। এ কারণে ছোট বয়সেই আয় রোজগারে লেগে পড়তে হয় তাঁকে। কাজ শুরু করেন মায়ের সাথে নার্সারিতে। এ কারণে স্কুলের আঙিনায় পা রাখার সুযোগ হয়নি তার। তবে বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণের প্রতি তাঁর ঝোঁক মুগ্ধ করেছিল বন অধিদফতরের কর্তা ব্যক্তিদের। তাই তারা তুলসী গৌড়াকে বন অধিদফতরের নার্সারিতে স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।
তুলসীকে নিয়ে এক টুইট-বার্তা দিয়েছে ভারতের রাষ্ট্রপতির কার্যালয়। টুইটে বলা হয়েছে, গাছ লাগিয়ে ছয় দশক ধরে পরিবেশ সংরক্ষণে অবদানের জন্য তুলসীর হাতে পদ্মশ্রী পুরস্কার তুলে দিয়েছে ভারত সরকার।
পদ্মশ্রী পাওয়ার আগে তুলসী গৌড়া সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তবে এসব পুরস্কার তার কাছে গৌণ। তার কাছে মূখ্য বিষয় হচ্ছে গাছ লাগানো, সেগুলোর যত্ন নেওয়া। কারণ গাছ ও সন্তান তার কাছে ভিন্ন কিছু নয়। এমনকি পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপ্তির তালিকায় তার নাম ঘোষণা হওয়ার পর অসংখ্যবার তিনি গণমাধ্যমকে এই কথাটিই বলেছেন।
ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার গ্রহণ করতে যেখানে সবাই দামি পোশাক পরে হাজির হয়েছেন সেখানে পরনে নিজ সম্প্রদায়ের খাটো শাড়ি আর খালি পায়েই ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের হাত থেকে পদ্মশ্রী পুরস্কার গ্রহণ করেছেন তুলসী গৌড়া। সাদামাটা এই ছবিটি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। নেটিজেনরা এটাকে পুরস্কার বিতরণের সেরা ছবি হিসেবে অবহিত করেছেন।
বন অধিদফতরের চাকরি থেকে তুলসী গৌড়া অবসর নিয়েছেন এক দশক আগে। তবে সরকারিভাবে তার গাছ লাগানো থেমে গেলেও থেমে যায়নি তার দুটি হাত। এখনও মানুষটিকে সকাল হলেই দেখা যায় গাছের চারা হাতে নিয়ে কোনো এক বৃক্ষহীন প্রান্তরের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। কারণ তিনি জানেন ও মানেন-গাছ পৃথিবী ও মানুষের পরম উপকারী বন্ধু