ক্ষণজন্মা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ‘কলম’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘হে কলম! তুমি ইতিহাস গিয়েছ লিখে/লিখে লিখে শুধু ছড়িয়ে দিয়েছ চতুর্দিকে/তবু ইতিহাস মূল্য দিবে না এতটুকু কোণ/দেবোনা তোমায়, জেনো ইতিহাস বড়ই কৃপণ’।
সত্যি ইতিহাস বড় কৃপণ। কারও কারও ইতিহাস চাপা পড়ে যায় সময়ের আবর্তে। কেউ কেউ এই পৃথিবীতে আবার জীবনের সূর্য উঠার আগেই অস্তাচলে ছুটে যায় মরনের কাছে। ঠিক যেন কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের লেখা ‘ড্যাফোডিল’ কবিতার মতো। সকালে ফুটতেই যে ফুল সন্ধ্যায় ঝরে যায়। ঠিক তেমনি ১১ বছরের একটি বাচ্চা ঘাতকের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিল। নিভে গিয়েছিল তার জীবন প্রদীপ। কিন্তু লেখা হয়নি তাকে নিয়ে কোন কবিতা, গল্প। গল্প, কবিতা না লেখা হলেও তার ভাইবোনের কাছে সে এখনো ছোটই রয়ে গেছে।
অথচ দেখতে দেখতে কেটে গেছে চার দশকের বেশি সময়। এমন আরও কত দশক চলে যাবে। একদিন হয়ত বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে ১১ বছরের শিশুর জীবন কাহিনি। এই শিশুটির নাম ছিল আরিফ আব্দুল্লাহ সেরনিয়াবাত। তিনি অসাম্প্রদায়িক, সাধারণ এবং নিরাভরন কৃষক নেতা, বাংলাদেশের সাবেক ভূমি প্রশাসন, ভূমি সংস্কার ও ভূমি রাজস্ব ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কনিষ্ঠ সন্তান। তাঁর মা আমেনা বেগম হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেজো বোন আমেনা বেগম হেলেন।
আরিফ সেরনিয়াবাত বরিশালের কালিবাড়ী রোডের নিজ বাড়িতে ১৯৬৪ সালের ২৯ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজধানী ঢাকার ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে বেশীদিন শ্রেণিকক্ষে এবং বিদ্যালয়ের মাঠে খেলাধুলা করার সুযোগ পাননি। তার সহপাঠী এবং বন্ধু ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ট সন্তান শেখ রাসেল। কিন্তু নিয়তির পরিহাস এই দুই সহপাঠী বেশীদিন পৃথিবীর আলো ছায়ায় বেড়ে উঠতে পারেনি। এই শিশুটি পরিবার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, ভালো খাবার রান্না হলে গরীবদের বিতরণ করতে হয়। তিনি তাই করতেন। দেশ বিদেশের ডাকটিকিট সংগ্রহ করতেন। তিনি অসাধারণ প্রতিভাবান ছিলেন। ভালো ফুটবল খেলতে পারতেন। বাম হাত দিয়ে হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন, গানের সুর নিজেই তুলতে পারতেন।
একবার বঙ্গবন্ধুর সামনে গেয়েছিলেন, ‘মুজিব বাইয়া যাওরে, নির্যাতিত দেশের মাঝে/জনগণের নাওরে মুজিব বাইয়া যাওরে।’ এই গানটি শুনে বঙ্গবন্ধু তার জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালকে বলেছিলেন, আরিফকে ছায়ানটে ভর্তি করিয়ে দিস। তখন শেখ কামাল ছায়ানটে শিক্ষার্থী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী তাকে ছায়ানটে ভর্তি করা হয়।
আরিফ আবদুল্লাহ সেরনিয়াবাতের বড় ভাই আবুল খায়ের আবদুল্লাহ তার স্মৃতিচারণে বলেন, আরিফ রেডিওতে গান শুনে গান গাইতে পারত। মাঝে মাঝে ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে/রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে’ এই গানটি গাইত’। ভীষণ মিশুক ছিল আমার ছোট ভাই।’
তাঁর বড় বোন হুরুন্নেসা মঞ্জু বলেন, ১৪ আগষ্ট ১৯৭৫-এ তার দাদীর মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদে তাদের বাড়িতে গেলে তার ভাই তার কাছে ২০ টাকা চেয়েছিল, জুস খাবে এজন্য। তিনি ২০ টাকা না দিয়ে ১০০ টাকা দিয়েছিলেন। বোন এই স্মৃতি আজও ভুলতে পারেন না।
তাঁর আর এক বড় বোন হামিদা সেরনিয়াবাত বিউটির স্মৃতিকথায় দেখা যায়, ১৪ আগষ্ট, ১৯৭৫ বিকেলে দাদীর মৃত্যুবার্ষিকী মিলাদের পর আরিফ, রাসেল, সুকান্ত অন্যসব বাচ্চা খেলনা পিস্তল দিয়ে চোর পুলিশ খেলেছিল। কে জানতো সেই খেলনা পিস্তল সত্যি হয়ে ঐ রাতেই তিনটি কচি প্রাণ কেড়ে নিয়ে যাবে। আরিফ আমার ছোট ভাই। সবার আদরের। বেঁচে থাকলে হয়তো ভালো শিল্পী হতে পারতো। কিন্তু ঘাতকেরা বাচতে দিল না। নির্মম বুলেট তাদের প্রাণ কেড়ে নেয় ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টে।
‘আরিফ’ নামের অর্থ বিজ্ঞ, জ্ঞানী। ঠিক যেন নামের সাথে মিলে যায় তার ছোট জীবনটি। অতটুকু বাচ্চা রেডিওর গান শুনে হারমোনিয়ামে সুর তুলতে পারত। জন্মগতভাবেই সে ছিল প্রতিভাবান। তাঁর ব্যবহৃত হানমোনিয়ামটি এখনো আছে। কিন্তু সেই হারমোনিয়ামে সুর তুলেনা আরিফ। জীবনের সব সুর তাল লয় স্তব্ধ হয়ে এখন তিনি পরপারে। এই শিশুটি বড় হলে একজন ভালো সঙ্গীতশিল্পী হতে পারত। কিন্তু অকালে ঝরে যাওয়া এই নিষ্পাপ ফুলটি সুগন্ধ ছড়িয়ে দেবার আগেই তার জীবন কেড়ে নিয়েছে বুলেট। আরিফ সেরনিয়াবাত তাঁর বাবা মায়ের সাথে বনানী গোরস্থানে শুয়ে আছে। দিন আসে, রাত আসে। আরিফ সেরনিয়াবাত পৃথিবীতে ফিরে আসেনা। শেষ করব আরিফ সেরনিয়াবাতের প্রিয় গানের কয়েকটি চরণ দিয়ে-‘এর দুঃখের চিঠি পড়বেনা জানি কেউ কোন দিনও/এর জীবনের দুঃখ কেমন, জানবে পথের তৃণ/এর দুঃখের কথা জানবেনা কেউ শহরে ও গ্রামে/এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে’। আরিফ সেরনিয়াবাতের ৫৭তম জন্মদিনে তাঁর দুঃখের কালো খামটি হোক শ্বেত শুভ্র চিঠির খাম। সে চিঠির খামের ভিতরে রঙিন কাগজে ‘শুভ জন্মদিন আরিফ’ লিখে আকাশের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম।
তথ্যসূত্র: ১. শহীদ আরিফ আবদুল্লাহ সেরনিয়াবাতের বোন হুরুন্নেসা মঞ্জু, হামিদা সেরনিয়াবাত এবং হাবিবুন্নেছা শিউলীর সাক্ষাৎকার, ১০.০৯.২০২১। ২. শহীদ আরিফ আবদুল্লাহ সেরনিয়াবাতের ভাই আবুল খায়ের আবদুল্লাহর সাক্ষাৎকার, ০৪.০৯.২০২১। ৩. ‘আমাদের বাড়িতে যেভাবে হত্যাকাণ্ড চালানো হলো’, হামিদা সেরনিয়াবাত, দৈনিক ভোরের কাগজ, ১৫,১৬,১৮ আগষ্ট, ১৯৯৪।
লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।