মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শব্দ সৈনিক, প্রয়াত সাংবাদিক কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি সংবাদ বিভাগ গড়ে তোলার পাশাপাশি সংবাদ পাঠ, কথিকা লেখা ও প্রচার, ঘোষণা, সম্মিলিত গানে কণ্ঠ দেওয়া ইত্যাদি কাজ করেছেন। কামাল লোহানী এক নিবন্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঈদ আয়োজন সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে:
‘একাত্তরে তখন চলছে মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আর অবরুদ্ধ বাংলায় ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালির ঘরে এসেছে ঈদের বার্তা। কিন্তু কি করে পড়বো ঈদের জামাত? আমরা দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে লড়াই করছি রণাঙ্গনে। মাথায় টুপির বদলে হেলমেট, নয়তো গামছা বাঁধা। সারাক্ষণ ব্যস্ত শত্রুর মোকাবিলায়, সময় কোথায় ঈদ করার? তাইতো ক্ষুদ্ধ শব্দ সৈনিক শহীদুল ইসলাম ঈদের চাঁদকে ফিরে যেতে বললেন। তিনি লিখলেন: ‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও ফিরে যাও, দেখো, মানুষের খুনে খুনে রক্তিম বাংলা, রূপসী আঁচল কোথায় রাখবো বলো?’
প্রখ্যাত গণসঙ্গীতশিল্পী সুরকার অজিত রায় এই গানে সুর সংযোজন করেন। ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর চাঁদ রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী গানটি প্রচার করা হয়। পরদিন ঈদ উপলক্ষ্যে এই বেতার কেন্দ্র থেকে সেই যুদ্ধদিনেও কয়েকটি অনুষ্ঠান প্রচার হয়েছিল। সেদিন ঘোষণায় বলা হয়েছিল:
‘‘অফুরন্ত আনন্দের বন্যা নিয়ে ঈদ আসে আমাদের দ্বারপ্রান্তে। রমজানের শেষে এবারো এসেছে ঈদুল ফিতর। কিন্তু এবারের ঈদ বয়ে আনেনি সেই আনন্দবন্যা। পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বাংলার মাটি বাংলার আকাশ আজ রক্তরাঙা। এবারের ঈদ তাই আমাদের জীবনকে অগ্নিশপথের আলোকে বিচার করার দিন। এগিয়ে চলার মুহূর্ত। এখন শুনবেন “রমজানের ওই রোজার শেষে”- একটি স্মৃতি আলেখ্য।’’
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সেই স্মৃতি আলেখ্য রচনা করেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। প্রযোজনা করেন মেসবাহ আহমেদ। স্মৃতি আলেখ্যটি তুলে ধরা হলো:
বাংলার আকাশে আবার শাওয়ালের চাঁদ উদিত। অঘ্রানের কুয়াশামাখা দিগন্তে এক ফালি খণ্ড চাঁদে কত আলো আর আনন্দের প্রত্যাশা! কিন্তু সেই আলো আর আনন্দ আজ এমনভাবে নিভে গেল কেন? আকাশে যেন চাঁদ নয়, চাঁদের করোটি। ঈদের আহত চাঁদের গা বেয়ে যেন ঝরছে চাপ চাপ রক্ত। বাংলার আকাশ আজ লাল, মাটি আজ লাল। হেমন্তের পাখি গান গায় না। নবান্নের ধান কুমারী মেয়ের মতো বাতাসের প্রথম সোহাগে আর আন্দোলিত হয় না বাংলাদেশের সবুজ খেতে। শাওয়ালের চাঁদ, তবু তুমি এসেছো মৃত্যুদীর্ণ বাংলার আকাশে। আলো আর আনন্দের সব পসরা দূরে রেখে। এসেছো রক্তাক্ত দেহে। এসেছো নিহত শিশুর আর নারীর লাশের ছবি বুকে গেঁথে-
“ওরে বাংলার মুসলিম তোরা কাঁদ, এনেছে এজিদ বাংলার বুকে মোহাররমের চাঁদ। এসেছে কাসেম এসেছে সখিনা সারা দেহে হায় তপ্ত খুন আজ নয় ঈদ, আজ কোটি মুখে ইন্নালিল্লা... রাজেউন। ওরে বাংলার মুসলিম তোরা কাঁদ এনেছে এজিদ আবার এদেশে মোহাররমের চাঁদ।”
শাওয়ালের চাঁদ নয়, মোহাররমের চাঁদ। না, তা কি করে হয়? রমজানের পর কি মোহাররম না শাওয়াল?
শাওয়াল। কিন্তু বাংলার আকাশে এখন রমজানের পর মোহাররম। শাওয়ালের চাঁদ পথ ভুলে গেছে। এজিদের তরবারির ভয়ে, বর্বরতার ভয়ে বঙ্গোপসাগরে উঁকি মারতে এসে সে পালিয়ে যার তার সব আলো আর আনন্দ নিয়ে দূর আরবের মরু বিয়াবানে। এবার দামেস্কে নয়, ঢাকায় হয়েছে এজিদের অভ্যুদয়। তার সীমার সেনারা ঘুরছে বাংলার পথে পথে। লুট করছে নারীর ইজ্জত, হত্যা করছে রোজাদার বাঙালিকে। এজিদের বাবা যেমন একদিন বর্শার আগায় পবিত্র কোরান বেঁধে বিভ্রান্ত করেছিল আরবের মুসলমানদের এ যুগের এজিদ ইয়াহিয়াও তেমনি ইসলাম আর কোরানের দোহাই পেরে বিভ্রান্ত করতে চাইছে বাংলার মুসলমানকে। সে যুগের এজিদ ছিল মুসলমান। এ যুগের ইয়াহিয়াও মুসলমান। এজিদ কারবালায় হত্যা করেছে দশ হাজার মুসলমানকে। আর ইয়াহিয়া বাংলাদেশে হত্যা করেছে কয়েক লাখ মুলমানকে।
ঠিক। ঠিক। এজিদ বলেছিল, আরবের মুসলমানকে খেলাফত দেব না। আমি চাই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। ইয়াহিয়া বলছে, বাংলার মুসলমানকে আমি গণতন্ত্র ও স্বাধীকার দেব না। আমি চাই মিলিটারি ফ্যাসিজম কায়েম রাখতে। আলোচনার নামে এজিদের বন্ধু কুফার বিশ্বাসঘাতক মুসলমানেরা মহানবীর নয়নমণি ইমাম হোসেনকে পথ ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কারবালায়। তার পিপাসার্ত স্ত্রী, পুত্র, শিশুকে এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত দেয়নি খেতে। এ যুগের ইয়াহিয়া আলোচনার নামে বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করেছে। আজ তিনি কোথায় কেউ জানে না। কেউ জানে না।
[নেপথ্যে সমবেত কণ্ঠে] তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব বাংলাদেশের প্রাণে গানে চিরঞ্জীব শেখ মুজিব, শেখ মুজিব॥
বঙ্গবন্ধু আছেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বুকে। ইয়াহিয়া ও টিক্কার মতো নরপশুদের সাধ্য নেই এই নামটি বাঙালির বুক থেকে মুছে দেয়।
নবীর নয়নমণি ইমাম হোসেনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল কুফাবাসী বিশ্বাসঘাতক কয়েকজন মুসলমান। বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধুর মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বাংলার কয়েকজন কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক মুসলমান। নুরুল আমিন, হাসিদুল হক চৌধুরী, ফরিদ আহমদ, কাসেম, সোলায়মান, খাজা খায়রদ্দি, গোলাম আজম, মাহমুদ আলী গয়রহ। এদের চরম শাস্তির দিন আজ সমাগত। বাংলার বুক থেকে এই নামগুলোর অপবিত্র অস্তিত্ব মুছে দিতে হবে।
এবার নিয়ে দু’বার মোহাররমের চাঁদ এলো আকাশে শাওয়ালের চাঁদের পরিবর্তে। গত বছর ঠিক রোজার ঈদের আগে বারোই নভেম্বরের কাল-রাত্রিতে বিশ লাখ বাঙালি নিশ্চিহ্ন হয়েছে প্রচণ্ড ঝড়ে। সেদিনও ইয়াহিয়া পিণ্ডির শাদ্দাদী বালাখানায় বসে হেসেছে। বাংলার মানুষকে বাঁচাতে, বিপন্ন মানবতার ত্রাণে নেমে আসেনি এই মনুষ্যদেহধারী জানোয়ার গোষ্ঠী।
গত ঈদেও সারা বাংলা কেঁদেছে। কেউ গায়নি প্রাণভরে- ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ- গেয়েছে মোহাররমের মসিয়া, ঈদের জামাত হয়েছে- জানাজার জামাত।
বাংলার মানুষের কণ্ঠে শুনেছি তারই অর্তি ক্ষোভ-
“বাঁচতে চাইলে বাঁচবে এমন কথা তো নেই প্রমাণ পেলে তো হাতে হাতে বিশ লাখ শিশু নারী ও যুবক আজকে নেই মরে গেছে তারা এক রাতে বাঁচতে গেলেই বাঁচবে এমন কথা তো নেই॥ প্রভু, তুমি এই পুণ্যির মাসে ধন্যি, ঝড়ে নেভায়েছো লক্ষ প্রাণের বহ্নি সাগরে ডুবেছে আমার স্বপ্ন-শিশুরা তোমার ধ্যানেতে নিরত এখনো যীশুরা আর যারা আছে, তারা প্রাণ দেবে নীরবে- নাহলে তোমার পুণ্যিমাসের কি রবে? কাফনে জড়ানো চাঁদের শরীর গলিত লাশ দ্বীপাঞ্চলের বাতাস এখন দীর্ঘশ্বাস গোলাপপের মত কত ফোঁটা ফুল লুণ্ঠিত মৃত্যু মলিন ঠোঁটে চাপা ক্ষোভ কুণ্ঠিত॥”
গেলবার প্রকৃতির হাতে মারা পড়েছে লাখো লাখো মানুষ। সেই মৃত্যুদীর্ণ বাংলার বুকে আবার আঘাত হানতে দ্বিধা করেনি রক্তপাগল নরপশু ইয়াহিয়া। এ বছর মরেছে দশ লাখ। ১ কোটি মানুষকে হতে হয়েছে দেশছাড়া। বাংলার ঘরে ঘরে আজ হাজার সখিনার শরীরে শ্বেতবাস। কাসেমের লাশে ভরে গেছে বাংলার প্রান্তর। শাওয়ালের চাঁদের ছদ্মবেশ ধরে আবার বাংলার আকাশে উঠেছে মোহাররমের চাঁদ।
আবার শয়তান সীমারের ছুরি উদ্যত হয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীর বুকে। পবিত্র রমজান মাসে কারফিউ জারি করা হয়েছে ঢাকা শহরে। ঘরে ঘরে চলছে সার্চ, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ। শাওয়ালের চাঁদ, তুমি মুখ ঢাকো। তোমার আলোয় যারা মোনাজাতের হাত তুলবে পশ্চিমমুখো হয়ে পবিত্র কাবাঘরকে সাক্ষী রেখে, যারা জামাতে শামিল হয়ে করবে এবাদত, তারা আজ কোথায়? তাদের কঙ্কালের স্তূপে, তুমি কিসের আলো ছড়াবে- আনন্দের, না শোকাশ্রুর? [নেপথ্যে গান] ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দিবি শোন আসমানি তাগিদ॥
না শোকাশ্রুর নয়, সংকল্পের। এবারের শাওয়ালের চাঁদ বাঁকা খঞ্জন হয়ে বাংলার মানুষকে পথ দেখিয়েছে। উঠুক মোহাররমের চাঁদ বাংলার আকাশে। আমরা কাঁদবো না। অশ্রু ফেলবো না। বাংলার তরুণের হাতে আজ অস্ত্র। ঈদের চাঁদের বাঁকা শরীরের মতো বাঁকা তলোয়ার। শত্রুনিপাতের সংকল্পে আজ ঐক্যবদ্ধ লক্ষ বাঙালি তরুণ। ওই দ্যাখো, সীমারের চোখে আজ ভয়। এজিদের চোখে ঘনায়মান পরাজয়ের আতঙ্ক।
[আবার গান] রমজানের ওই রোজার শেষে...
রমজানের রোজার শেষে এবারের ঈদ খুশির ঈদ নয়, সংকল্পের ঈদ। সংকল্পবদ্ধ হওয়ার খুশির ঈদ। শত্রুবধের খুশির ঈদ। দেশ ও মাতৃভূমির জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার খুশির ঈদ। আত্মোৎসর্গের ঈদ। শহীদি দরজা খুলে দেওয়ার ঈদ। গাজী হওয়ার- বিজয়ী হওয়ার আনন্দের ঈদ।
[আবার গান] রমজানের ওই রোজার শেষে...
হেমন্তের আর্দ্র কুয়াশামাখা চাঁদের কি সজল মিনতি- বাংলার যুবশক্তি রুখে দাঁড়াও। বাংলার আকাশে বজ্রে ও বিদ্যুতে কি গভীর কানাকানি- বাংলার মানুষ, বজ্র-কঠিন শক্তিতে আঘাত হানো। ঈদের জামাতে শামিল হয়ে যে হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে মোনাজাতের জন্য, সে হাত দৃঢ়মুষ্টিতে পরিণত করে শেষ আঘাত হানো হানাদার দস্যুর উপর। বাংলার বাতাস থেকে মোহাররমের মর্সিয়া মুছে দাও, বাংলার আকাশ থেকে মোহাররমের চাঁদকে বিদায় দাও। আসুক পুণ্য বিজয়ের ঈদ, শাওয়ালের চাঁদ। চূড়ান্ত বিজয়ের চাঁদ আলো আর আনন্দ ছড়াক শত্রুমুক্ত বাংলার আকাশে। রমজানের রোজা, ত্যাগ, কৃচ্ছতা, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের শেষে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবনে সত্যি সত্যি আসুক প্রকৃত খুশির ঈদ। গানে গানে ঝংকৃত হোক কোটি বাঙালির হৃদয়, আর সেই দৃঢ় প্রত্যাশায় বুক বেঁধে বলি- মোবারক হো ঈদ, ঈদ মোবারক। [গান-রমজানের ওই রোজার শেষে...॥]
রক্তে রাঙা ঈদ শিরোনামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বদরুল হাসান রচিত ‘জীবন্তিকা’ প্রচারিত হয়।
রক্তে রাঙা ঈদ
শরীফ- দেখছি ঐ ভাঙা বাড়িটার দেয়ালের ওপর দিয়ে, পোড়া গাছটার মাথা ছুঁয়ে ঈদের চাঁদ উঠেছে- একফালি সরু চাঁদ! কবীর হ্যাঁ, অসংখ্য শহীদের বুকের পাঁজরার হাড় যেন চাঁদ হয়ে ফুটে উঠেছে আকাশের গায়ে। পড়িসনি নজরুলের ‘কৃষকের ঈদ’? শরীফ- নিশ্চয়ই পড়েছি। বাংলার নিঃস্ব শোষিত জনগণের মর্মকথাকে নজরুল প্রাণস্পর্শী ভাষায় ছন্দে প্রকাশ করেছেন- জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধার আসে না নিদ ক্ষুধাতুর সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ? কবীর- আমারও প্রশ্ন তাইরে লক্ষ লক্ষ মানুষের লাশ বুকে নিয়ে সারা বাংলা যখন গোরস্থান- নির্যাতিত শিশু, নারী, বৃদ্ধার কান্নায় বাংলা যখন ক্রন্দসী, মজলুম মানুষের ফরিয়াদে বিশ্বের বাতাস ভারাক্রান্ত তখন ঈদকে খুশির ঈদ বলে মোবারকবাদ জানাতে পাচ্ছি না।
শরীফ- তবু তো প্রকৃতির নিয়মের ব্যতিক্রম হতে পারে না- রোজই সূর্য উঠছে ভোরকে রাত্রির কোল থেকে ছিনিয়ে আনতে। আবার সে সূর্য অস্ত যায়, সন্ধ্যে আসে ছায়াভীরু পদক্ষেপে। কবীর- কিন্তু আমরা কী আগের মতো, সেই ভয়ঙ্কর রাক্ষুসে রাত ২৫শের পূর্বে, যেমন করে সকালের সূর্যের আলোয় নেমে উঠতাম তেমনটা কি এখন পারি? গন্ধ্যা মায়াময় গন্ধ ছড়ায় না। একটা ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করে ঐ অন্ধকারে গা ঢেকেই পাক হানাদাররা আমাদের আক্রমণ করেছিল, আজও করছে, দিনেরাতে আমরা সবসময়ই মৃত্যুর মুখোমুখি- শয়তানের সম্মুখীন। শরীফ- জানি কবীর, আমরা তাই গতানুগতিকভাবে ঈদকে মোবারকবাদ জানাতে পারব না, তেমন করে খুশির ঢেউয়ে গা ভাসাতে পারব না, কিন্তু তাই বলে ঈদুল ভিতর তো ফিরে যাবে না আমাদের দ্বার থেকে।
কবীর- না, ফিরিয়েও দেবো না আমরা। নতুনভাবে ঈদকে স্বাগত জানাব। [নেপথ্যে মেশিনগানের শব্দ] ঐ শোনো গুলির শব্দ, সংঘর্ষ চলছে হানাদারদের সাথে মুক্তিবাহিনীর- (একটু হেসে) ঢাকায় ঈদেও চাঁদ দেখলে ছোট ছেলেরা পটকা ফুটাতো উল্লাসে, আজকের পটকা ঐ গুলির আওয়াজ, বোমার আওয়াজ।
শরীফ- বেশ তো আজকের ঈদকে আমরা সংবর্ধনা জানালাম বন্দুকের গুলি ছুড়ে, শপথ নিয়ে, কসম খেয়ে- বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে ঈদের প্রকৃত তাৎপর্যে খুশির বন্যা বইয়ে দেবো ঘরে ঘরে। আমাদের জীবনের ঈদকে যারা চির ম্লান করে দিতে ঘরে ঘরে আগুন জ্বালিয়েছে, আমাদের ঈদকে যারা চির ম্লান করে দিতে ঘে ঘরে আগুন জ্বালিয়েছে, আমাদের মা বোনের ইজ্জত নিয়েছে তাদের পশুহস্তকে চূর্ণ করেই পালন করবো ‘ঈদোৎসব’।
মা- হ্যাঁ, বাবা শরীফ, তোরা কি কেবল গল্প করবি? একটু কিছু মুখে দিবি না? ইফতার করেছিস দু’টুকরো রুটি খেয়ে। শরীফ- দেবো মা। একমাসের সিয়াম আমাদের চরিত্রে এনেছে দৃঢ়তা, হৃদয়ে দিয়েছে বল, অনুভূতিকে করেছে তীক্ষ্ম বাহুতে দিয়েছে লড়াই-এর শক্তি। কবীর- সেই শক্তিকে আমরা নিয়োগ করব শত্রুবিতাড়নের সংগ্রামে। নার্গিস- ভাইয়া শুনেছ, পাক বেতার কি জঘন্য প্রচার চালাচ্ছে! শরীফ- কীরে? নার্গিস- ওরা বলছে ঈদের দিনে মুক্তিবাহিনী ঈদের জামাতে আক্রমণ করবে, দাঙ্গাহাঙ্গামা বাঁধাবে। কবীর- ওরা প্রচারপত্রও ছেড়েছে ঢাকা শহরে, আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কুৎসা রটিয়ে। নার্গিস- কী জঘন্য। আমরা ইসলাম ধর্মের শত্রু। এই কথাটাই প্রচার করতে চায় তারা, অথচ মেয়েদের ইজ্জত নষ্ট করে ইসলামের কি নাম তারা করল?
শরীফ- যারা মানবতার শত্রু, তারা ইসলামের সকল ধর্মের শত্রু। কবীর- তাছাড়া মসজিদের উপর গোলাবর্ষণ করে ভেঙে চুরমার করেছে খোদার ঘর! কারা নামাজরত মুসুল্লিদের হত্যা করে রক্তে ভাসিয়েছে মসজিদের পবিত্র অঙ্গন? আমরা, না পাক হানাদাররা? শরীফ- আজ বিশ্বের সকলেই জানে ওদের ঐ ধর্মবিরোধী বর্বরতার ইতিহাস। তবু তাদের মিথ্যা ভাষণের বিরাম নাই। কবীর- আসল মতলব কি জানিস! ’৪৮ সালে পেশোয়ারের সীমান্ত এলাকায় ঈদের জামাতে বোমাবর্ষণ করে কাইউম-লীগ সরকার হাজার হাজার পাঠানদের হত্যা করেছিল। ৫৮ সালে আয়ূব আমলে এই নর রাক্ষস টিক্কাখান বেলুচিস্থানে ঈদের জামাতে বোমা ফেলেছিল। এবারে বাংলাদেশে একই পৈশাচিকতার পুনরাবৃত্তি করতে চায় ওরা।
নার্গিস- আর তাই করে দোষ চাপাতে চায় বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণের উপর। শরীফ- কিন্তু ওদের সে পরিকল্পনা সফল হবে না। আজকের বাঙালি অনেক বিচক্ষণ- আঘাতে আঘাতে তারা গনগনে লোহার মতো সুকঠিন হয়েছে, হয়েছে ধারালো। কবীর- ঈদের ময়দানকে যদি ওরা জঙ্গেও ময়দান করে তুলচে চায়, তবে পাবে তার চরম শাস্তি। আল্লাহ এই অপরাধ ক্ষমা করবেন না। লানৎ নেমে আসবে ওদের মাথায়। শরীফ- শহীদ-ই-ঈদগাহে আজ জমায়েত ভারী। আমাদের দুঃখকে আমরা ভুলেছি শহীদের আত্মদানের শিক্ষায় বীর সেনাদের বীরত্বের গৌরবে, শত্রুর প্রতি চরম ঘৃণায়। রক্তে রাঙা ঈদের চাঁদ শত্রুমুক্ত শোষণমুক্ত বাংলার পতাকায় ছড়াবে নতুন আলো।
এ ছাড়াও ঈদ উপলক্ষ্যে ‘রক্তরাঙা ঈদুল ফিতর’ শিরোনামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুস্তাফিজুর রহমান রচিত ৩টি সঙ্গীতালেখ্য প্রচারিত হয়।
রক্তরাঙা ঈদুল ফিতর
১ মাহে রমজান ত্যাগ ও তিতিক্ষার এক অপূর্ব প্রতীক। সংযত চরিত্রের মানুষের জন্য এ মাস এক বিরাট নেয়ামত। কিন্তু আজ বাংলার মাটিতে যে দাবানল জ্বলে উঠেছে তাও এবারের রমজান এবং ঈদুল ফিতর পেয়েছে নতুন অর্থ। এবং তারই আলোকে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বাংলা মানুষ। ক্ষতবিক্ষত বাংলা। ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত। নতুন শপথে ভাস্বর এবারের ঈদুল ফিতর। আনন্দ নয়, সংগ্রাম প্রত্যয়ে দৃঢ় তাই বাংলার মানুষ।
আজ নয় নয়, নয় কোনো অভরণ রক্তে রক্তে বাজে দুন্দুভি শপথ নেয়ার দিন আজকে প্রাণের মহফিলে বাজে রুদ্র রৌদ্র বীণ॥
সাড়ে সাত কোটি মানুষের বুকে হানে যারা খঞ্জর নয় ক্ষমা নয় হানো হানো তারে দুর্জয় দুর্বার উদ্যত মুঠি করো না শিথিল মুক্তি সেনানী বীর॥
আজকে তিমির পল্ললে শোন জীবনের মহাগান জয় সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি জয় জয় মহীয়ান। রক্ত রঙিন বাংলার বুকে অতন্দ্র প্রহরায় জাগে নির্ভীক লাখে। সৈনিক নাই ভয়, ভয় নাই বঞ্চিত আজি জাগ্রত ওই এসেছে মুক্তিদিন॥
২ দুর্জয় সাহস, দৃঢ় মনোবল নিয়ে প্রতিরোধ করছে শত্রুর হামলা প্রতি দিন এই বাংলার মানুষ নতুন এক সম্ভাবনায় হয়ে উঠছে উজ্জীবিত। অপূর্ব এই মহাজাগরণ। বাংলার মাটি, বাংলার মানুষ আজ ধন্য। পূর্ণতর এক জীবনের সন্ধানে আজ দেখছে নতুন স্বপন। নতুন সূর্যদিন ডাকছে ওদের হাতছানি নিয়ে। এক দিগন্ত থেকে অন্য আরেক দিগন্তে আজ তাই চলেছে প্রাণের উল্লাসে।
এগিয়ে চলো দিগন্ত থেকে দিগন্তে আজ এগিয়ে চলো। এগিয়ে চলো॥ এগিয়ে চলো॥ হিংস্র শ্বাপদ ওই হানাদার নিঃশেষে নাম মুছে ফেলো তার বাঙালির তরে বাংলার মাটি নিশঙ্ক আজ বলো॥
মায়ের বোনের ভাইয়ের রক্তে ভিজে গেছে এই মাটি প্রাণের চেয়েও প্রিয়তম তাই এ মাটি অনেক খাঁটি॥
এ মাটির বুকে কোন অনাচার সইবো না কেউ সইবো না আর হাতে হাতিয়ার নির্ভয় প্রাণ জ্বেলে দাও সব আলো।
৩ আজ নয় হিসেব-নিকেশের দিন, আজ নয় আনন্দ-উৎসবের দিন, আজ শুধু সংগ্রাম, ঘরে বাইরে দুঃসহ দারুণ সংগ্রাম। কাপুরুষ হানাদারদের নিঃশেষে খতম করে তবেই আমরা হবো নিশ্চিন্ত। আজ এই দিনে আমরা তাই শপথ নিই- দেহের সর্বশেষ রক্তবিন্দু দিয়ে আমরা অর্জন করব আমাদের স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতা আমাদের জীবনের চেয়ে মহান।
বাংলার নাম আজ শপথ নিলাম মুজিবের নামে আজ শপথ নিলাম বাংলাকে করবোই মুক্ত শত্রুর বিষদাঁত ভাঙবোই ভাঙবোই আজ আর নয় কোন শর্ত।
কৃষক শ্রমিক চায় মুক্তি মুক্তি ছাত্র মজুর চায় মুক্তি মুক্তি সাড়ে সাত কোটি এই জনতার ইচ্ছা মুক্তির জন্যে হয় হোক মৃত্যু॥
বাংলার বুকে যারা জ্বেলে দিল দাবানল তারে আজ ক্ষমা নয়, ক্ষমা নয় লেলিহান অগ্নির দুঃষহ প্রান্তে দুশমন পুড়ে আজ হোক ছাই॥ শহর নগর চায় মুক্তি মুক্তি বাংলার গ্রাম চায় মুক্তি মুক্তি ত্রাসের কাঁপন লাগে শত্রুর বক্ষে বাংলার বুকে ওরা একেবারে রিক্ত॥