সাতসতেরো

কোথাও কেউ নেই...

দোয়ায় বসে আছেন ষাটোর্ধ বৃদ্ধ। এক ধ্যানে দুহাত তুলেছেন। সব হারিয়ে ছোট্ট নৌকাটিই তার শেষ আশ্রয়স্থল। আশপাশে কেউ নেই। চোখ ফুলে গেছে চোখের পানিতে। আল্লাহ একমাত্র রক্ষা করতে পারেন— এমনটাই হয়তো মোনাজাতে চাইছিলেন তিনি। এ দৃশ্যে হৃদয় নাড়া দিয়ে উঠে। চারদিকে অথৈ পানি। কোথাও কেউ নেই, শুধু পানি আর পানি। 

শুধু এই একটি ছবিই নয়, সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যায় আক্রান্ত হাজারো ভারাক্রান্ত ছবির মিছিল এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রতিটি স্থিরচিত্রেই রয়েছে ব্যাকুলতা-হাহাকার। সাজানো সংসার ভেসে গেছে পানিতে। এক রাতের পানির স্রোতে তলিয়ে গেছে তাদের লালিত স্বপ্ন। 

গত দিনও তারা এমনটা ভাবেননি। চোখের পানি ফেলা ছাড়া কিছুই আর রইলো না। অবলা প্রাণীগুলোও একই আকুতি জানাচ্ছে। তাদের চোখে-মুখেও খাদ্য সংকটের ছাপ। পাকা সড়ক-ব্রিজ ভেঙে যাচ্ছে। যাওয়ার জায়গাটুকু নেই। পানিতে ভাসতে হচ্ছে প্রাণীগুলোকে। 

ঘরের ছোট্ট শিশুটি তো সাঁতার কাটতে পারে না। তাকে কে দেখবে? বাবা-মায়ের চোখেও আতঙ্কের বার্তা। একদিকে পানিবন্দি জীবন, অন্যদিকে সদ্যজাত শিশু। কোনও দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাদের এখন দরকার প্রসারিত সাহায্যের হাত। বন্যার এই ভয়াবহতা কাটিয়ে তারা ফিরতে চায় স্বাভাবিক জীবনে। দেশ যে এখন বন্যায় আক্রান্ত। কূলহীন পানিতে বয়ে চলছে দুঃখের স্রোত...!

বন্যা পরিস্থিতির বিস্তারিত:

গত দুদিন ধরে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে ১২টি উপজেলা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৪ লাখেরও বেশি মানুষ।

ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় পানিতে ভাসছে মানুষজন। এ ছাড়া গৃহপালিত পশু-প্রাণী নিয়েও পড়েছেন বেশ বিপাকে।

আবহাওয়াবিদরা জানান, মেঘালয়ের বৃষ্টির পানি এসে সিলেট বিভাগে বড় বন্যা সৃষ্টি করেছে। এই বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা সুনামগঞ্জে।

বন্যার পানিতে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধারে সিলেট এবং সুনামগঞ্জের আট উপজেলায় সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে।

সেখানকার প্রতিটি ঘরবাড়ি পানির নিচে। কোনও কোনও ঘরবাড়ির চালের ওপর দিয়ে পানি যাচ্ছে। অনেকে পরিবার নিয়ে বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছে। গবাদিপশু, হাঁস মুরগি সব পানিতে ভেসে যাচ্ছে। জেলা শহরের সব রাস্তায় পানি।

কোথাও বুক সমান পানি এবং কোথাও তার চেয়েও বেশি। সুনামগঞ্জের সঙ্গে যোগাযোগের হাইওয়েগুলোও পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে শহর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।   

সিলেটের কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্রে বন্যার পানি উঠায় পুরো সিলেট জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পানি নেমে গেলে উপকেন্দ্রটি আবার চালু করা হবে।

এ ছাড়া সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছাকাছি বন্যার পানি চলে আসায় বিমান চলাচল তিন দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি বন্যার পানিতে রেল লাইন ডুবে যাওয়ায় সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

ভয়াবহ বন্যায় পানিবন্দি হাজারো মানুষ এখনও উদ্ধারের অপেক্ষায়। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ভাড়ার কারণে তাদের উদ্ধারের জন্য স্বজনরাও নৌকা নিয়ে তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। আবার কোথাও কোথাও অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও নৌকা মিলছে না।

সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় শতাধিক যাত্রীবাহী নৌকা ছাড়াও বালুবাহী নৌকাও বন্যাদুর্গতদের সরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে। কিন্তু নৌকার মালিক ও মাঝিরা সব নৌকার ভাড়া অন্তত শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন।

আগামী দুই দিনের মধ্যে উত্তরাঞ্চল ও দেশের মধ্যাঞ্চলের আরও কিছু জেলা বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে। কারণ সেসব এলাকায় বন্যার তীব্রতা বাড়ছে।

নদীগুলোর পানি আরও বাড়তে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।

এদিকে গত দুই দিন ধরে পুরো সুনামগঞ্জ শহর বিদ্যুৎবিহীন এবং মোবাইলে নেটওয়ার্ক না থাকায় কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছে না। পানিবন্দিরা জানান, আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি। ছেলে-মেয়ে নিয়ে না খেয়ে আছি। এখন পর্যন্ত কেউ এসে আমাদেরকে ত্রাণ সহায়তা দেয়নি।

অন্যদিকে, বন্যার সঠিক তথ্য দ্রুত পৌঁছাতে গণমাধ্যম বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। এজন্য গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশংসা করেছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম।

মন্ত্রী বলেন, ‘যেকোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আপদকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার ফলে সরকার জানতে পারে এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়।’

সর্বশেষ, বন্যাদুর্গত এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে (স্কুল ও কলেজ) অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। বন্যার কারণে এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।